গল্পস্বল্প: জলে নেমেও বাঙালি সোনা আনতে পারে, ১০০ বছর আগেই শিখিয়েছেন শচীন
১৯৫১ সাল। স্বাধীনতা এসেছে মাত্র ৪ বছর। উঠে দাঁড়ানোর যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে একটা জাতি। তার মাঝেই ক্রীড়াক্ষেত্রে একের পর এক সাফল্য। লস এঞ্জেলস, বার্লিন, লন্ডন অলিম্পিকে হকিতে পরপর সোনা। ভারতীয় মাইনর স্পোর্টসের স্বর্ণযুগ। সাফল্যের রাস্তায় হাঁটা শুরু। যে পথ ধরে এসেছে আরও সফলতা
দিব্যেন্দু ঘোষ
বেনারসে গঙ্গার ঘাটে পা ডুবিয়ে বসে থাকত ছেলেটা। মনে মনেই শুধাত, 'নদী তুমি কোথা হইতে আসিয়াছো? কোথায় যাইবে?' নদী ছোট্ট ছেলেটার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিল কি না, সে প্রশ্ন সেই কবে তলিয়ে গেছে অতল জলরাশিতে। গঙ্গা বইত, তখনও। আজও বয়ে চলে আপন খেয়ালে। কিন্তু বেনারসে জন্ম হওয়া সেই ছেলেটার কথা ভুলে গিয়েছে আসমুদ্র হিমাচল। কত উত্থান-পতনের সাক্ষী থেকেছে গোটা দেশ। কিন্তু জল-দাপানো স্বপ্ন-বোনা এক উত্থানের ইতিহাস পাতার ভাঁজে আনমনে লুকিয়ে পড়েছে। আজ সে-পাতা খোলার বড্ড প্রয়োজন। এশিয়ান গেমসে ভারতের প্রথম সোনার পদক জেতা নিপাট বাঙালিকে ভুলে গেলে ইতিহাস ক্ষমা করবে কি?
২০২০। শচীন নাগের জন্মশতবর্ষ I স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতের বুকে, এশিয়ার শ্রেষ্ঠ সাঁতারু। সেই নীল জলে অজস্র ভেসে যাওয়া ইতিহাসের মাঝে, ছলাত্ ছলাত্ শব্দে কান পেতে অতীতের কিছু গল্প শুনে নেওয়ার দিন আজ। সেও যে এক রূপকথা।
বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন শহর বেনারস। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই বাস বহু বাঙালি পরিবারের। এমনই এক বাঙালি পরিবারে ১৯২০-তে জন্ম শচীন নাগের। কাশী বিশ্বনাথ মন্দির আর দশাশ্বমেধ ঘাটের সেই রোমাঞ্চ দেখে বড় হওয়া। জল কেটে তরতরিয়ে এগিয়ে যাওয়া, কিংবা ঝুপ করে ডুব দিয়ে অনেক দূরে হুস করে ভেসে ওঠা। শচীনের দিনলিপিতে ঢুকে গিয়েছিল। মাত্র ১০ বছর বয়সেই মজার ছলে পুলিসের হাত থেকে পালাতে গঙ্গায় ঝাঁপ দিত ছোট্ট শচীন। তারপর দুই নৌকোর মাঝে নিজেকে আড়াল করার জন্য অদ্ভুতভাবে নিজেকে নিয়ে যেত জলের তলায়। বন্ধুদের সঙ্গে বাজি রেখে ডুবসাঁতার দিত। সে সময়ে গঙ্গায় সাঁতার প্রতিযোগিতা ছিল খুব জনপ্রিয়। বাংলাতেও প্রায়শই গঙ্গাবক্ষে সাঁতার প্রতিযোগিতার আসর বসত। এমনই এক প্রতিযোগিতায় মাত্র ১২ বছর বয়সে অদ্ভুতভাবেই নাম দেন শচীন। পেশাদার সাঁতারুদের হারিয়ে তৃতীয় হয়ে চমকে দেন। সেই শুরু। নিজের আত্মজীবনীতে এই সাঁতার প্রতিযোগিতার কথা সুন্দরভাবে লিখে রেখে গেছেন। কেরিয়ারের উত্থানে ওই সাঁতার প্রতিযোগিতার প্রভাব ছিল অপরিসীম।
আরও পড়ুন- গল্পস্বল্প: মহানায়কের মৃত্যুর ঠিক ২৪ ঘণ্টা আগে...
১৯৩০ থেকে ৩৬। টানা ৬ বছর নানা ছোটো-বড় সাঁতার প্রতিযোগিতায় নাম দিয়ে একের পর এক পদক। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই শচীন হয়ে ওঠেন পেশাদার সাঁতারু। এর পরই শচীন চলে আসেন কলকাতায়। সে সময়ে বাংলা মানে জাতীয় স্তরে সাঁতারের আঁতুড়ঘর। কলকাতায় বিখ্যাত হাটখোলা ক্লাবে শুরু হয় প্রশিক্ষণ। বেঙ্গল স্টেট চ্যাম্পিয়নশিপে দুই দুঁদে সাঁতারু মদন সিনহা ও রাজারাম সাহুকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হন শচীন। ১০০ মিটার ও ৪০০ মিটার পেশাদার ফ্রি-স্টাইলে সেটাই ছিল শচীন নাগের প্রথম পদক। ফ্রি-স্টাইল সাঁতারের পাশাপাশি ওয়াটারপোলোতেও ধার বাড়তে শুরু করে শচীনের। সেই সময়ে দিলীপ মিত্র ও দুর্গা দাস ছিলেন ভারতীয় সাঁতারের দুই দিকপাল। ১৯৪৮ লন্ডন অলিম্পিকে ভারতের প্রতিনিধিত্ব তো করেইছিলেন। পাশাপাশি ১ মিনিট ৪ সেকেন্ডে ১০০ মিটার ফ্রি-স্টাইলের জাতীয় রেকর্ড গড়েন দিলীপ মিত্র। কিন্তু শচীন নাগ অন্য ধাতুতে গড়া। ভেঙে দিলেন দিলীপ মিত্রের ১০০ মিটারের জাতীয় রেকর্ড। ভবানীপুরে মাত্র ১ মিনিট ২.২৫ সেকেন্ডে গড়লেন নয়া রেকর্ড। টনা ৩১ বছর সেই রেকর্ড কেউ ভাঙতে পারেননি।
১৯৪৮ লন্ডন অলিম্পিকে দিলীপ মিত্রের সঙ্গে শচীনও জলে নামেন। ১০০ মিটার ফ্রি-স্টাইলে বিশেষ সুবিধে করতে পারেনি ভারত। ওই অলিম্পিকেই ভারতের ওয়াটারপোলো দলের সদস্যও ছিলেন শচীন। ফ্রি-স্টাইল শর্ট ও লং ডিসট্যান্স সুইমিং-এর পাশাপাশি ওয়াটার পোলোতেও দেশের প্রতিনিধিত্ব করার মতো বিরল কৃতিত্বের অধিকারী তিনি। ১৯৪৮ অলিম্পিকে ভারত ওয়াটারপোলোতে ৭-৪ গোলে হারায় চিলিকে। সেই ম্যাচে ভারতের হয়ে ৪টি গোল করেছিলেন শচীন নাগ।
আরও পড়ুন- গল্পস্বল্প: সে দিন মিটু থাকলে বায়োস্কোপে প্রথম যৌন হেনস্থার শিকার হয়তো কাননদেবীই
১৯৫১ সাল। স্বাধীনতা এসেছে মাত্র ৪ বছর। উঠে দাঁড়ানোর যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে একটা জাতি। তার মাঝেই ক্রীড়াক্ষেত্রে একের পর এক সাফল্য। লস এঞ্জেলস, বার্লিন, লন্ডন অলিম্পিকে হকিতে পরপর সোনা। ভারতীয় মাইনর স্পোর্টসের স্বর্ণযুগ। সাফল্যের রাস্তায় হাঁটা শুরু। যে পথ ধরে এসেছে আরও সফলতা। গোটা দুনিয়া চিনছে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটা দেশের পরাক্রম। ১৯৫১-য় প্রথম এশিয়ান গেমসের আসর বসল দিল্লিতে। শচীন নাগের কেরিয়ারের শ্রেষ্ঠ অধ্যায়। ১০০ মিটার ফ্রি-স্টাইলে সোনা জিতলেন তিনি। প্রথম ভারতীয় হিসেবে এশিয়া-শ্রেষ্ঠ। সম্মান জানালেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। স্টেডিয়ামে বসে শচীনের সাঁতার দেখে মুগ্ধ পণ্ডিত নেহরু। ওই একই এশিয়ান গেমসে ৪X১০০ মিটার ফ্রি-স্টাইল রিলেতে ব্রোঞ্জ জেতেন শচীন। তাঁর সঙ্গে রিলেতে ছিলেন বিমল চন্দ্র, ইশাক মনসুর এবং শম্ভু সাহা। ৩X১০০ মিটার মেডলে রিলেতেও ব্রোঞ্জ জেতেন শচীন। সঙ্গী ছিলেন কান্তি শাহ এবং জাহাঙ্গির নইগামওয়ালা।
আরও পড়ুন- গল্পস্বল্প: প্রেম, দাম্পত্য, বিচ্ছেদ- তসলিমাকে নিজের হাতে গড়েছিলেন কবি রুদ্র
শুধু কি বাঙালি বলেই থেকে গেছেন বিস্মৃতির অতলে? ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা সাঁতারু হয়েও প্রকৃত স্বীকৃতি কি জুটেছে? ১৯৮২ সালে ভারতে ফের এশিয়ান গেমসের আসর বসে। আমন্ত্রণপত্রটুকু যায়নি কিংবদন্তি ক্রীড়াবিদের কাছে। অথচ ভাবতে অবাক লাগে, এশিয়ান গেমস ভিলেজ সিরি ফোর্টে একটি ব্লকের নামাঙ্কন হয় স্বর্ণজয়ী এই বাঙালির নামে।
আরও পড়ুন- গল্পস্বল্প: “বিধান তুমি থাকতে আমার শ্যামা ভুল চিকিৎসায় মারা গেল”
তবু থেমে থাকেনি শচীন নাগের শিক্ষাদান। তাঁর হাত ধরে উঠে এসেছেন আরতি সাহা, নাফিসা আলির মতো দুর্ধর্ষ সাঁতারুরা। ভারতীয় সাঁতারের এক উজ্জ্বল প্রজন্ম তৈরি করে দিয়ে যান ৬ ফুট উচ্চতার সুঠাম চেহারার শচীন। ১৯৮৭ সালে ৬৭ বছর বয়সে জলকে টা টা গুডবাই জানান শচীন। তার আগে ১৯৮৪ সালে মতি নন্দীর উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি কোনি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি।
হাসতে হাসতে দ্রোণাচার্য পুরস্কার পাওয়ার কথা। কিংবা নিদেনপক্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও স্বীকৃতি। দিল্লির সিংহাসনে সরকার বদল হয়েছে। বারবার প্রতিশ্রুতি এসেছে নাগ পরিবারের কাছে। কিন্তু স্বীকৃতি মেলেনি। আর্থিক সাহায্য় চাননি কখনও। শুধু একটু স্বীকৃতি। তাও জোটেনি। কিছুটা কষ্ট নিয়েই চলে গেছেন এশিয়ান গেমসে প্রথম সোনাজয়ী ভারতীয় শচীন নাগ।
আরও পড়ুন- গল্পস্বল্প: ফ্যাতাড়ুরা যে কখন বিস্ফোরণ ঘটাবে সরকারও টের পাবে না!
বারাণসীর গঙ্গা হয়ত আজও দস্যি ছেলেটার দামালপনার সাক্ষী থেকে গেছে। আজও হয়ত গঙ্গা বয়ে চলার সময় তাঁর পদধ্বনি শুনতে পায়। নিস্তরঙ্গ জল কখনও শচীনের দু হাত আর পায়ের নিপুণ আড়ম্বরে চঞ্চল হয়ে ওঠে। একশো বছর পেরিয়েও গঙ্গা তার বেগবান গতিকে শচীনেই হয়ত সমর্পণ করে দিয়েছে। তবে আজ শচীন বললে জল নয়, বরং ডাঙার সবুজ ঘাস জেগে ওঠে। উইলো আর চামড়ার সখ্যতায় নিখুঁত শট তৈরি হয়। বাউন্ডারির বাইরে আছড়ে পড়ে কভার ড্রাইভ, স্কোয়ার কাট কিংবা পুল। উল্লাসে ফেটে পড়ে গ্য়ালারি। সে শচীন তেন্ডুলকর। তবে আপামর বাঙালিরও এক শচীন আছে। এক্কেবারে নিজের শচীন নাগ। তাঁকে বড় যত্নে রাখা উচিত ছিল। স্মৃতির আদরমাখা উত্তাপ থাকার কথা ছিল। শুধু জলের মানুষ নয়, মাটির মানুষটাকে মনে রাখার কথা ছিল। বাঙালি কথা রাখেনি। একবুক জলে যে মানুষটা বারবার নিপুণ সন্তরণে নটআউট থেকেছে, বাঙালির মন থেকে বেমালুম আউট হয়ে গেছেন তিনি। শুধু রূপকথার আয়োজনে জলের যুবরাজ হয়েই থেকে গেছেন শান্ত, ভদ্র, অমায়িক জলমানব।