জীবন যার সাইকেলে! পর্তুগালের ওই বন্ধুকে খোলা চিঠি
সৌরভ পাল
চুরি হয়ে যাওয়া একটা সাইকেল। দু'জন মানুষ। দু'জনের দূরত্ব ১৩ হাজার ২২২ কিলোমিটার। আর এখান থেকেই শুরু হারনানি কার্দোসোর গল্প। একটা উন্মাদ সফর। একটা সাইকেলেই জীবন যার!
বন্ধুত্ব কী হয়? বন্ধু মানে 'আমার পরান যাহা চায়/তুমি তাই, তুমি তাই গো।' বন্ধুত্বের গান, 'বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচে না/আমি রব না রব না গৃহে'। হারনানি পর্তুগিজ, বাংলাটা বোঝেন না। তবে যেটা বোঝেন, সেটা বাকিদের থেকে ভালো বোঝেন। বন্ধুত্ব। হ্যাঁ। আবারও বলছি হারনানিই বোঝেন 'বন্ধুত্ব'। পর্তুগিজ হারনানির বুকের বাঁ দিকটা কল্পনায় চিরে ফেলেছিলাম। বুঝতে চেষ্টা করছিলাম ওই কলজেটায় কী আছে? আমাদের মতই কী ওর হৃদপিণ্ড? যখন হারনানির হৃদয়ে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করলাম, দেখালাম আর উপলব্ধি করলাম ওটাই 'বন্ধুত্বের মক্কা' ওর চারিদিকে রয়েছে মোহনার নদী যার ওপরে ঢেউ আসছে যাচ্ছে অনবরত। তবে খুব শান্ত। আর ভিতরটায় অগ্ন্যুৎপাত। আর যখন হৃদপিণ্ড দেখে বাইরে এলাম, অনুভব করলাম দাবানল চলছে ওর মধ্যে। একথা হারনানি নিজেও স্বীকার করে যে ও একটা আস্ত 'ক্ষ্যাপা'। পাগল না হলে কি কেউ সাইকেলে বিশ্ব আবিষ্কার করতে বেরিয়ে পরে? অবশ্য ওর উপায়ও ছিল না, বন্ধু বিনে ওর প্রাণ বাঁচে না, তাই তো গৃহবন্দি না হয়ে বেরিয়ে পরা। সাইকেলে প্যাডেল করতে করতে হারনানি পেরিয়ে যাচ্ছে দেশ, মহাদেশ, সমুদ্র। মানুষ আসে মানুষ যায়, ঢেউয়ের মত আছড়ে পড়ছে রাত দিন, হারনানি যেন 'দিকশূন্য' পথের পথিক। চলেই চলছে।
তবে হঠাৎ কেন সাইকলে করে বিশ্ব ভ্রমণের পিপাসা?
লেখা শুরুর তিন নম্বর লাইনটায় বলেছিলাম, দুজন মানুষের কথা। একজন মানুষের পরিচয় দিলাম। হারনানি। আর অন্যজন না থাকলে তো গল্পটাই হত না। সেই অন্যজন হল হারনানির বন্ধু এরিক। এই এরিকের জন্যই উন্মাদ হারনানি। না এরিক কিন্তু কোনও মহিলা নন, যার প্রেমে হাবুডুবু হারনানি। এরিক হারনানির বন্ধু। পরিচয় হয়েছিল একটা সাইকেল যাত্রায়। দুজনেই সাইকেল নিয়ে মাইলের পর মাইল পথ চলেছেন। হঠাৎ একদিন এরিকের সাইকেলটা চুরি হয়ে যায়। সফর শেষ না করেই ভাঙা মন নিয়ে নিজের বাড়ি চিনে ফেরে এরিক। সেদিন যখন এরিকের চোখের কোণায় বৃষ্টি হয়েছিল ছাতা ধরতে পারেননি হারনানি। মনে মনে এভারেস্টের সমান বেদনা জমে ছিল, আর হারনানির কষ্টের পাহাড়ের মাথায় সাদা বরফের চাদর ছিল জেদ। বন্ধুর সাইকেলটা খুঁজে বার করবেন। শেষমেশ পেলেনও। তাহলে এবার বন্ধু বন্ধুকে সাইকেলটা ফেরত দেবে, এটাই তো গল্প। না। আসলে গল্পটা শুরু। হারনানি সাইকেল ফেরত দেবেন ঠিকই তবে এরিকের অসমাপ্ত সফর সম্পূর্ণ করে। উড়োজাহাজ নয়, ট্রেন নয়, বাস নয় হারানানি সাইকেলে প্যাডেল করেই পৌঁছে যাবেন বন্ধু এরিকের দরজায়।
শুরু হল সফর। পাহাড়, মরুভূমি, রাস্তা হারনানি সাইকেল চালাচ্ছেন। বিশ্ব ভ্রমণ। ইরান, ইরাকের গোলা-গুলি আর বারুদ গন্ধ কাটিয়ে হারনানি চলছেন। পার করলেন ইংলিশ চ্যানেল। লাতিন দেশ থেকে ইউরোপ থেকে এশিয়া। যেন 'কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা...', মনে মনে তো বটেই সাইকেলও। চেনা শোনার বাইরে, যেখানে পথ নাই, নাইরে, সেখানে অকারণে যাই ছুটে। হারনানিও ছুটছেন। চাকা দুটো পৃথিবীর মত ভন ভন করে ঘুরছে আর হারনানি ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব দেখবে আর ভারত দেখবে না, এমনটা হয় নাকি। হারনানি এসে হাজির ভারতে। কলকাতা ভাল লেগেছে হারনানির। তবে শুধু ভাল। আর রাজস্থানের ভালো লাগাটা যেন এক ম্যাচে দশটা সেঞ্চুরি পাওয়ার মত আনন্দ। ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডর দেশের নাগরিক, CR7 এক ম্যাচে দুটো হ্যাটট্রিক করলে যতটা খুশি হয় হারনানি ঠিক ততটাই খুশি রাজস্থানকে দেখে। আর ভালো লেগেছে গোয়ার নীল সমুদ্রও। হারনানি কলকাতায় ছিলেন তেঘরিয়াতে কৈখালির কাছে একটি হোটেলে। তাবু খাটাতে হয়নি বলে একটু খুশিও ছিল ও। তবে মনটা খারাপ ছিল সাইকেল চালাতে না পেরে। কলকাতার কোনও এক লরি চালক রাস্তাকে ফর্মুলা ওয়ান ভেবে প্রায় হারনানির ওপরে উঠিয়ে দিয়েছিল পাঞ্জাব লরি! কোনও মতে বাঁচোয়া। চোট পাননি, তবে ভেঙেছে সাইকেলটা। আর মনে একটু ভয়ও আছে। মজা করে হারনানি বলেছিল, "U people driving like crazy. Incredible!"। তবে কলকাতা থেকে হারনানি নিয়ে যাচ্ছে মুগ ডাল। হ্যাঁ। ও মনে করে এটাই ভারতের শ্রেষ্ঠ স্ন্যাকস্। আর মনে প্রাণে ভালবেসেছে বাঙালির সফট অথবা হট ড্রিংক 'চা'। মশলা চা কীভাবে বানাতে হয়, এটাও শিখেছে। এক কাপ চায়ে ডুব দিয়ে হারনানির মুখে তৃপ্তি যেন মরিচিকা কাটিয়ে মরুভূমিতে জলপ্রপাত। সময় শেষ। হারনানি এবার মালশিয়ার উদ্দেশ্যে। কুয়ালালামপুর, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড হয়ে এরিকের দেশ চিনে। ইতিহাসের পাতায় হারনানিকে নিয়ে লেখা হবে, কি হবে না জানিনা, তবে 'হামারি আধুরি' কাহানি হয়ত লিখতে হবে আমাকেই! শেষ মেইলটায় ওর লেখা, 'আমার সঙ্গে ডিনারটা তো করলে না, নিশ্চয় দেখা হবে পর্তুগালে অথবা অন্য কোথাও'। মনে মনে বললাম তাই যেন হয়। ভাল থেকো। তোমার ওয়ার্ল্ড ট্যুরের তথ্যচিত্রে নিজেকে সামিল করে গর্বিত আমি। পর্তুগাল মানে আমার কাছে শুধু CR7 যে থাকল না, ওই দেশের কথা মনে পড়লেই আমার মনে তোমার বিজয় কেতন উড়িয়ে দেব। কথা দিলাম। আমি না গেলেও আমার লেখা তোমার কাছে পৌঁছে যাবে।