মতামত: বঙ্গ রাজনীতিতে তারকা, 'শেষ পাতে চাটনি'
১৯৫২ সালের প্রথম নির্বাচনে দুই তারকার দেখা মেলে। হরিন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং পি লক্ষমায়া।
সব্যসাচী চক্রবর্তী
প্রার্থী কে হবেন? তাই নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি তুঙ্গে। সমাধান কি? দিয়ে দাও তারকা প্রার্থী। বামেদের কালচারকে আরও যত্নে সাজিয়ে গুছিয়ে তুলেছে তৃণমূল। তাই যাদবপুরের মতো ঐতিহ্যশালী কেন্দ্রেও প্রার্থী বনে যান মিমি কিংবা বসিরহাটে নুসরত। রাজ করে যান, দেব, শতাব্দী বা মুনমুন। কিন্তু এঁদের নিয়ে কি ভাবে দল? এ হেন কালচারই বা বাংলায় ঢুকলো কী করে? সত্যিই কি তারকা প্রার্থী, ভোট বৈতরণী পার হওয়ার সহজতর উপায়?
যুক্তি না, আবেগ
শুরুতেই একটা কথা মেনে নেওয়া ভাল। ভোটে, সাধারণ মানুষ যুক্তির থেকে আবেগকে প্রাধান্য দেন বেশি। লোকসভা হোক বা বিধানসভা, দুই ক্ষেত্রেই উন্নয়ন আর মুখ, দুটো বড় ফ্যাক্টর। মুখ বা ইমেজের আবেগ থেকেই রাজনীতিতে তারকাদের অনুপ্রবেশ। দক্ষিণ ভারত পথ দেখিয়েছে। এ বাংলায় ভোটের পথে প্রথম তারকা এনেছে বামেরা। অনুপকুমার বা অনিল চট্টোপাধ্যায়দেরও ভোটে দাঁড়াতে দেখেছে তত্কালীন লাল বাংলা। আর তৃণমূলের আমলে তো তারার হাট।
শো-স্টপার দক্ষিণ
এমজি রামচন্দ্রন বা এমকে করুণানিধি থেকে জয়ললিতা। তামিল রাজনীতি দেখেছে স্টার পাওয়ার। সেখানে রাজনীতি মাথা নোওয়ায় তারকার ছটার কাছে। তাঁদের দৌলতে আঞ্চলিক দল জায়গা করে নিয়েছিল জাতীয় রাজনীতিতে। তারকাখচিত সেই পথে অবশ্য এর আগেই একটু একটু করে হাঁটতে শুরু করে দিয়েছিল কংগ্রেস।
১৯৫২ সালের প্রথম নির্বাচনে দুই তারকার দেখা মেলে- হরিন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং পি লক্ষমায়া। ১৯৬০ সালে প্রথম সংসদে যে বলি অভিনেতা পা রাখেন, তিনি পৃথ্বীরাজ কাপুর কংগ্রেসের হয়ে। জওহরলাল নেহরু তাঁকে দিয়ে কালচারাল ডিপ্লোমেসি চালিয়েছিলেন। শোনা যায়, স্তালিন নাকি নেহরুর কাছে আওয়ারা আর রাজ কাপুর সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। তবে প্রথম ফিল্মস্টার মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু দিয়েছিল দক্ষিণই। AIADMK-এর এমজিআর। আর DMK দেখিয়েছিল, কীভাবে সিনেমাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা যায়। তারকা খচিত পথে হেঁটেছে বিজেপিও। কারণ গ্রামীণ এলাকায় রাজনৈতিক দাঁও মারতে সিনে গ্ল্যামারের জুরি নেই। দিলীপ কুমার, সুনীল দত্ত থেকে অমিতাভ বচ্চন, রাজেশ খান্না, ধর্মেন্দ্র, শত্রুঘ্ন সিনহা বা গোবিন্দা থেকে হালফিলের উর্মিলা মাতন্ডকর। পিছিয়ে নেই ক্রীড়া ব্যক্তিত্বরাও। কীর্তি আজাদ, আজহার, সিধু কিংবা লক্ষ্মীরতন শুক্লা, জ্যোতির্ময়ী শিকদার বা প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে গৌতম গম্ভীর। তালিকা দীর্ঘতর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠতে পেরেছেন খুবই কম।
'শেষ পাতে চাটনি!'
কিন্তু বাংলায় তারকারা কখনও রাজনীতিকে ছাপিয়ে যেতে পারেননি। বরং এখানে রাজনৈতিক কারণেই তাঁদের ব্যবহার। অভিনেত্রী ও বিজেপি নেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন, রাজনৈতিক দলের নেতারা ক্রীড়া বা সিনে জগতের তারকাদের শেষ পাতে চাটনি হিসেবেই দেখেন।
তিন কারণে 'তারকা'
বাংলায় তারকা প্রার্থী দাঁড় করানোর কারণ মূলত তিনটি।
এক, প্রার্থী নিয়ে গোষ্ঠী কোন্দল সামাল দেওয়া।
দুই, দলের বিরুদ্ধে না যাওয়া অর্থাত্ স্রেফ পাপেট ক্যান্ডিডেট হয়ে থাকা
এবং তিন, অবশ্যই স্রেফ চমক, গ্ল্যামার। এ ভাবেই দেব, মুনমুন, সন্ধ্যা থেকে প্রসূন বা লক্ষ্মীরতনের জয় মিলেছে। তৃণমূলের আশা, মিমি বা নুসরতও এভাবেই উতরে যাবেন। থেকে যাবেন শতাব্দী, দেব বা মুনমুন।
আরও পড়ুন- মতামত: মোদীর 'শিশুপাল' বধ
তারকা প্রার্থী বনাম দলের আত্মবিশ্বাস
গতবারের থেকে এবার, সব দলেরই বাংলায় তারকা প্রার্থীর সংখ্যা কিছুটা কম। সংগঠন শক্তিশালী হলে এই প্রবণতা কমে বইকি। রাজ্যে বামেরা সেলিব্রিটিদের শহরেই প্রার্থী করেছেন। কারণ গ্রামের থেকে শহরে তাদের জনভিত্তি ছিল, অপেক্ষাকৃত কম। অনিল বা বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়রা শহরাঞ্চলেই প্রার্থী হয়েছিলেন। অনিল জেতেন, বিপ্লব হারেন। তবে পরে তারকার ছটা থেকে সরে আসে বামেরা। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মত, তারকা প্রার্থীর সংখ্যা যে দলে যত বেশি, সে দলের আত্মবিশ্বাস তত কম। তারকা আর তারকা নেতার মধ্যে ফারাক অনেক।
'ওঁরা আমাদের অতিথি'
আগে বাংলার ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব বা রূপোলি পর্দার জগতের মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা ছিল প্রবল। বিশেষ করে গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অনেকেই। এখন সে সচেতনতা তলানিতে। ফলে অধিকাংশ তারকাই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠতে পারেন না। স্রেফ অতিথি শিল্পী হিসেবেই থেকে যান তাঁরা। ২০১৪ সালে গত লোকসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর তারকা প্রার্থীদের নিয়ে বলেছিলেন, "ওঁরা আমাদের দলের অতিথি, ওঁরা সাংস্কৃতিক জগতে যেমন কাজ করছেন তেমনই করবেন'। নেত্রীর বক্তব্যেই পরিষ্কার, বঙ্গ রাজনীতিতে তারকাদের অবস্থান।
আরও পড়ুন- অডিও: আধা সেনাকে কাটিয়ে কীভাবে ছাপ্পা? কর্মীদের বোঝালেন তৃণমূল নেতা
প্রতিবেদনটি লেখকের ব্যক্তিগত মতামত। Zee গোষ্ঠী তাদের মঞ্চে সমস্ত মতের প্রতিফলনের পক্ষে। তবে লেখকের মতামতের দায় প্রকাশকের নয়।