আমার বিশ্বাস, উনি অন্য কোনও সাজঘরে আছেন, ওঁর সঙ্গে দেখা হবে: দেবশঙ্কর

আমরা যে কদিন বেঁচে থাকব, উনি আমাদের মধ্যে তো অবশ্যই বেঁচে থাকবেন, সোহিনী সেনগুপ্ত। 

Edited By: সৌমিত্র সেন | Updated By: Jun 16, 2021, 07:01 PM IST
আমার বিশ্বাস, উনি অন্য কোনও সাজঘরে আছেন, ওঁর সঙ্গে দেখা হবে: দেবশঙ্কর

নিজস্ব প্রতিবেদন: তিনি সত্যজিৎ রায়ের 'বিমলা'। সেই পরিচয়টাই তাঁর বড় হয়ে গিয়েছিল। অথচ তিনি ছিলেন থিয়েটারের সম্রাজ্ঞী। কিন্তু সিনেমাপ্রেমী বাঙালি দর্শক সব সময় তাঁর নাট্যপ্রতিভার কথা মনে রাখেনি। তিনি স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। আজ, ১৬ জুন কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে প্রয়াত হলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। 

'নান্দীকার' (Nandikar) নাট্যদলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন স্বাতীলেখা। দীর্ঘ নাট্য-কেরিয়ারের মধ্যেই ১৯৮৪ সালে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে পর্দায় 'ঘরে বাইরে'। তার পর আবার সিনেমা-বিমুখ ও নাট্য-প্রমত্ত এক যাপন তাঁর। যেখানে নিত্য-নিয়ত খচিত রচিত হয়েছে নাটকের নানা বিষয়, নানা আঙ্গিক, নানা মুহূর্ত।

আরও পড়ুন:  প্রয়াত সত্যজিৎ রায়ের 'ঘরে বাইরে' ছবির 'বিমলা' Swatilekha Sengupta

দীর্ঘ তিন দশক পরে সেই সৌমিত্রর (Soumitra Chatterjee) সঙ্গেই পর্দায় ফেরা। প্রযোজক-পরিচালক নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে  'বেলাশেষে' ছবিতে। সেই ছবিতেই তরুণ প্রজন্মের শিল্পীদের সঙ্গে কাজ। 

একটা দীর্ঘ শিল্পী জীবন। ১৯৭০-এর শুরুর দিকে এলাহাবাদে স্বাতীলেখার থিয়েটারে হাতেখড়ি। ১৯৭৮ সালে কলকাতায় চলে আসেন। নান্দীকারে যোগদান। কাজ শুরু রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের (Rudraprasad Sengupta) সঙ্গে। তারপর শুধুই সৃষ্টিসুখের উল্লাস। সেই রণন স্তিমিত হল আজ এই ভরা আষাঢ়দিনে।

মাকে হারিয়েছেন সোহিনী সেনগুপ্ত। বড় শোক, বড় আঘাত। তবু তারই মধ্যে তিনি মাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করলেন। বললেন,
'কালের নিয়মে সকলেই চলে যান। কিন্তু কাজ থেকে যায়। আমার মা অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। ইংরেজিতে গোল্ড মেডালিস্ট।  মিউজিক নিয়েও ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। খুব জেনারাস মহিলা ছিলেন। মা যে কত জনকে সাহায্য করেছেন তার কোনও ইয়ত্তা নেই। গানের ভাল শিক্ষক ছিলেন। অসামান্য অভিনেত্রী ছিলেন। আমরা যে কদিন বেঁচে থাকব, উনি আমাদের মধ্যে তো অবশ্যই বেঁচে থাকবেন। মা যা কাজ করে গিয়েছেন, তা যদি দর্শক মনে রাখেন, তবে মা'র কাজ রয়ে যাবে। 

এ কালের বিশিষ্ট নাট্যাভিনেতা দেবশঙ্কর হালদার দীর্ঘ স্মৃতিচারণ করেছেন। দৃশ্যতই আবেগবিহ্বল ও শোকসন্তপ্ত দেবশঙ্কর বলেন, 'ওঁর চলে যাওয়ায় কতটা ক্ষতি হল তা পরিমাপ করতে পারব না। আমার অভিনয় জীবন শুরুই ওঁর হাত ধরে। আমি যেদিন অভিনয় করব বলে এসেছিলাম নান্দীকারে, সেদিন আমি অভিনয়  করার যোগ্য কিনা আমাদের সেই পরীক্ষা উনিই নিয়েছিলেন। আমাকে নির্বাচনও করেছিলেন উনি। এবং তারপর তো মঞ্চে ওঁর সঙ্গে ৩৪ বছর ধরে অভিনয় করেছি। 

'কাছের মানুষ, বাড়ির মানুষ, চার দেওয়ালের মানুষ চলে গেলে যেমন হয়, তেমন একটা অনুভূতি হচ্ছে। বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠছে। মনে হচ্ছে এভাবে চলে যাওয়াটা কি ঠিক হল? কান্না পাচ্ছে। 

'উনি একজন পরিপূর্ণ শিল্পী। যিনি এই শিল্পের সমস্ত বিভাগে পারদর্শিনী। তিনি আমাদের কাছে পাঠ্যপুস্তকের মতো। তিনি সিনেমায় বা নাটকে যে কাজ করে গিয়েছেন সেগুলিই আমাদের পাথেয় হয়ে রইল। সেগুলি আমরা নেড়েচেড়ে দেখতে পারি বারবার। এবং শিখে নিতে পাারি, ওঁর শক্তি ও ক্ষমতা ঠিক কী ছিল, কোথায় ছিল। সব সময় সৃষ্টিশীল থাকতে চাইতেন। হয়তো নাট্য অনুবাদ করছেন বা কোনও চরিত্র নিয়ে ভাবছেন। সেটা নিয়ে পরের দিকে আমাদের সঙ্গেও আলোচনা করেছেন। ওঁর সঙ্গে অনেক ঝগড়া ও বন্ধুত্ব করার ছিল। সেটা করা যাবে না ভেবে খারাপ লাগছে। 

'উনি জীবনের রঙ্গমঞ্চ থেকে হয়তো চলে গেছেন, কিন্তু আমার বিশ্বাস, নাটকে দৃশ্যবদল ঘটলে যেমন সাজঘরে যান শিল্পী সেরকমই উনি অন্য কোনও সাজঘরে আছেন, ওঁর সঙ্গে দেখা হবে। 

'ওঁর চলে যাওয়াটা অপূরণীয় ক্ষতি। যেখানেই থাকুন ভাল থাকুন, শান্তিতে থাকুন।' 

বিশিষ্ট চলচ্চিত্রাভেনেত্রী, বাংলা ছবির অন্যতম উজ্জ্বল নায়িকা ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তও (Rituparna Sengupta) দু'একটি ছবিতে স্বাতীলেখার সঙ্গে কাজ করেছেন। কাজ করতে গিয়ে স্বাতীলেখার সঙ্গে তাঁরও একটা ভিন্ন ওয়েভ লেংথে যোগাযোগ তৈরি হয়ে গিয়েছে। তিনিও  শোকবিহ্বল। ঋতুপর্ণা বলেন, 'স্বাতীলেখা সেনগুপ্তের চলে যাওয়াটা মেনে নেওয়া যায় না। একটার পর একটা খারাপ খবর। কী করে যে নিজের মনকে বোঝাব, বুঝে উঠতে পারছি না। 

'উনি এত বড় একজন যোদ্ধা ছিলেন। বড় বড় সব যুদ্ধ জিতেছেন। বারবার। বিরল অভিনেত্রী, অসামান্য ব্যক্তিত্ব, অদ্ভুত সুন্দর মানুষ। অনেক কিছুই উনি নতুন সৃষ্টি করেছিলেন। নাটকের জায়গায় তো উনি সম্রাজ্ঞী। 

'আরও বহু অন্য গুণ ছিল। অভিনেত্রী হিসেবে দেখেছি পর্দায়। এত সাবলীল, এত অপূর্ব অভিব্যক্তি। আমি নিজেকে খুব 'প্রিভিলেজড' ও 'লাকি' মনে করি যে, ওরকম একজন সম্রাজ্ঞীর সঙ্গে আমি কাজ করতে পেরেছি। 'বেলাশেষে' ও 'বেলাশুরু' দুটোতেই খুব কাছ থেকে ওঁর সান্নিধ্য পেয়েছি। মায়ের সান্নিধ্য। 

'ওই ছবিগুলির সূত্রে একটা পরিবারের মতোই এক সঙ্গে ছিলাম আমরা। প্রত্য়েকেরই নিজেদের পরিবার আছে। তবু ছবি ঘিরে ওই পরিবারটা অন্যরকম। 'বেলাশেষে' ও 'বেলাশুরু'র এই পরিবারটা সারাজীবন থেকে যাবে। অনেক ভাল কাজ করলে বোধ হয় এমন মানুষদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ মেলে। কিছুদিন আগে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে হারালাম। এবার স্বাতীলেখা আন্টি। আমাদের ওই পুরো পরিবারটাই কানা হয়ে গেল। 

'তবে তাঁরা যা দিয়ে গেছেন তা যুগে যুগে থেকে যাবে। এঁরা আমাদের জন্য যা দিয়ে গেলেন তা আগামি প্রজন্ম উপলব্ধি করবে। এত বড় একটা 'লেগ্যাসি' রেখে গিয়েছেন। এর ধারক-বাহক যাঁরা তাঁরাই সেটা এরপর এগিয়ে নিয়ে যাবেন। 

'স্বাতীলেখা আন্টির মধ্যে অনেক ছেলেমানুষি ছিল। যেমন, প্রায়ই সোহিনী বলতেন, জানিস, মা না তোর বিষয়ে এটা বলেছেন! এত বিদুষী একজন মহিলা, তার পরেও ওঁর আমার কাজের প্রতি এভাবে খেয়াল রাখা। আমি জানি না, এই দুঃখ আমরা ভুলতে পারব কিনা।'

এ শহরের বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব কৌশিক সেনও (Kaushik Sen) মুহ্যমান। তিনি জানান, 'যাঁরা থিয়েটার ও চলচ্চিত্র ভালবাসেন তাঁরা স্বাতীদিকে মনে রাখবেন। এটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে, স্বাতীদি চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবটা মুছে যাবে।  এটা ঠিকই যে, থিয়েটারটা সিনেমার মতো থেকে যায় না, কিন্তু যাঁরা থিয়েটারের দর্শক, তাঁরা ভীষণ ডেডিকেটেড। তাঁরা অত চট করে সব ভুলে যান না। 

'স্বাতীদির যে লম্বা কেরিয়ার। সেখানে বিচিত্র সব কাজ। সেই গ্যালিলিওর জীবন থেকে শুরু করে 'শ্যামল রায়চৌধুরী' একক, 'শেষ সাক্ষাত্‍কারে' ছোট্ট একটা অংশ, 'শঙ্খপুরের সুকন্যা', এই 'নাচনি' পর্যন্ত। ওয়ান্ডারফুল জার্নি। 

'অনেক ব্যক্তিগত স্মৃতি আছে। আমার সঙ্গে একটা নিয়মিত যোগাযোগ ছিল ফোনে। সেটা আমার কাছে একটা বড় সঞ্চয় হয়ে থাকবে। উনি আমাদের কাজ দেখতে আসতেন। সেসব স্মৃতি অনেক। কিছুদিন আগে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ চলে গেলেন। এঁদের কথা ভাবলে মনটা খারাপ হয়ে যায়। চারপাশে একটা অন্ধকার যেন এখন। একটা বন্ধ্যা সময় চলছে।'

শহরের আর এক নাট্যব্যক্তিত্ব দেবেশ চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, স্বাতীলেখার চলে যাওয়াটা বাংলা থিয়েটারের অপূরণীয় ক্ষতি। তিনি বলেন, 'এটা পূরণ হওয়ার নয়। উনি আমাদের অভিভাবক ছিলেন। কয়েকদিন আগেই রুদ্রবাবুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। স্বাতীলেখার মৃত্যুতে আমাদের থিয়েটারের একটা বড় ক্ষতি হয়ে গেল।
 
'ব্যক্তিগত স্মৃতি অসংখ্য। কোনটা বলব। 'উইঙ্কল টুইঙ্কল' সূত্রে একটা কথা মনে পড়ছে। উনি এমনিতে খুব একটা লিখতে চাইতেন না। কিন্তু 'উইঙ্কল টুইঙ্কল' দেখে নাটকটা কেমন লাগল তা জানিয়ে সঙ্গে সঙ্গে একটা লেখা ইংরেজিতে লিখে আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেটা আজও রেখে দিয়েছি। ওটা একটা প্রেরণা।'   

(Zee 24 Ghanta App : দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App) 

আরও পড়ুন: স্বাতীলেখা সেনগুপ্তের প্রয়াণে শোকপ্রকাশ মুখ্যমন্ত্রী Mamata Banerjee-র

.