রবি-সাক্ষাতে ভারতের সনাতনী ধর্মভাবনা, সত্যের হদিশ আইনস্টাইনের
বিজ্ঞানের চিরাচরিত যুক্তি দিয়ে সত্যের অবলোকন করা যাবে না, তাও বুঝিয়ে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। আধার করছেন ভারতীয় দর্শনকে।
শুভঙ্কর মিত্র
ধর্ম কী? জলের ধর্ম উপর থেকে নীচে গড়িয়ে যাওয়া। নদীর ধর্ম বয়ে চলা। মানুষের ধর্ম বা রিলিজিয়নও গতে বাঁধা কিছু রীতি-নীতি আর উপাচার? পাশ্চাত্য ও মধ্যপ্রাচ্যের ধর্ম-ভাবনার সঙ্গে ফারাক রয়েছে ভারতীয় দর্শনের। গীতার ধর্ম, সত্যের প্রতিষ্ঠা। অশুভের বিনাশ। তা কোনও শৃঙ্খলবদ্ধ রীতি-নীতিতে সংজ্ঞায়িত নয়। প্রাচীন ভারতের ধর্ম-চেতনাই জারিত করেছিল রবীন্দ্রনাথকে। প্রার্থনা প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, 'উপনিষদ ভারতবর্ষের বনস্পতি।'
ইশোপনিষদের 'ইশা বস্যমিদঁ সর্বং যৎকিঞ্চ জগত্যাং জগৎ, তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্য স্বিদ্ধনম'- বারেবারে অনুরণিত হয়েছে রবীন্দ্র-হৃদয়ে। শ্লোকের অর্থ, অখিল ব্রহ্মাণ্ডে জড়-চেতন সমস্ত ঈশ্বরের দ্বারা ব্যপ্ত। ভোগ করো। কিন্তু আসক্ত হয়ো না। রবীন্দ্রনাথের ধর্মবোধ বাহ্যিক উপকরণে সীমিত নেই। বরং তা সীমিতের মধ্যে অসীমকে খোঁজার অবিরল চেষ্টা। তাই তো স্বচ্ছন্দে লিখতে পারেন,'অগাধ সমুদ্র-মাঝে স্ফীত ফেন যথা শূন্যময়, তেমনি পরম শূন্য তোমার মন্দির বিশ্বতলে,স্বর্ণ আর দর্পের বুদ্বুদ্!' শতাব্দী পেরিয়েও যখন রাজা অতিমারীর মাঝে রাম মন্দিরের ভূমিপুজো করেন, তখন কালোত্তীর্ণ রবির 'দীন দান'।
এহেন ভারতীয় দর্শনের সন্ন্যাসীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল বিজ্ঞানের সাধকের। সেটা ছিল ৪ জুলাই, ১৯৩০। বার্লিনে নিজের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ করেছিলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। ভাষাগত সমস্যা বাধা হয়েছিল বটে। তাতে ধর্ম ও বিজ্ঞান নিয়ে তাঁদের ভাবনার আদান-প্রদানের রসাস্বাদন তিক্ত হয়নি। বরং তা হয়ে রয়েছে সময়ের দলিল। সেই দলিল আজও প্রাঞ্জল। শুরুতেই আইনস্টাইন প্রশ্ন করেন, আচ্ছা বর্হিবিশ্বের বিচ্ছিন্ন কোনও ঐশ্বরিক শক্তিতে আপনি বিশ্বাস করেন? উত্তর দিতে গিয়ে উপনিষদের 'অহম্ ব্রহ্মাস্মি'কে আধার করেছেন রবীন্দ্রনাথ। বলেছিলেন, 'বিচ্ছিন্ন নয়। মানুষের অসীম সত্ত্বা ব্রহ্মাণ্ডের অন্তর্গত। এই অসীমের প্রকাশ ঘটে ব্যক্তির নিজস্ব সত্ত্বায়। মহাজাগতিক সত্য আদতে ব্যক্তির সত্যেরই স্বরূপ। নিজের ধারণাকে পোক্ত করতে কবি বিজ্ঞানের দলিলও উপস্থাপন করেছেন। তাঁর মতে,বস্তুর মধ্যে প্রোটন ও ইলেকট্রনের মধ্যে দূরত্ব রয়েছে। বাইরে থেকে সেটি অখণ্ড। একইভাবে ব্যক্তি পরিসর নিয়েই তৈরি হয় মানবসত্ত্বা। তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। ঠিক সেভাবেই গোটা বিশ্বের সঙ্গে আমাদের যোগ। মানুষের চেতনাই ব্রহ্মাণ্ড। সাহিত্য, শিল্প ও ধর্মীয় চৈতনার মধ্যে দিয়ে আমি সেই সত্যকে উপলব্ধি করি।
ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন আইনস্টাইন। তিনি প্রশ্ন করেন, ব্রহ্মাণ্ড নিয়ে দুটো আলাদা ধারণা রয়েছে। প্রথমত, মানব চেতনার উপরে নির্ভর করে বিশ্ব। আর একটা মানুষের ধ্যানধারণার বাইরে স্বাধীন। রবীন্দ্রনাথ তখন উত্তর দেন, বিশ্বের সঙ্গে সত্ত্বার অন্তঃরঙ্গতা হলে সে পরম সত্যকে অবলোকন করে। উপলব্ধি করে সৌন্দর্যকে।
মানুষ না থাকলে অ্যাপোলো অফ বেলভেডারকে (Apollo of Belvedere, ভ্যাটিক্যানের মূর্তি) সুন্দর বলা যাবে না? আইনস্টাইনের প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথের দ্ব্যর্থহীন, 'না'। বিজ্ঞানীর যুক্তি, আমি সৌন্দর্যের সংজ্ঞা বুঝতে পারলাম, তবে সত্যের ধারণায় সম্মত নই। রবীন্দ্রনাথ প্রশ্ন করলেন, এমনটা কেন? সত্য তো মানুষের মধ্যে দিয়েই প্রকাশিত।
তাহলে তো ব্রহ্মাণ্ড মানুষের রচিত একটা সংজ্ঞা? জানতে চান আইনস্টাইন। রবীন্দ্রনাথ বলেন,''অন্য কোনও ধারণা থাকতে পারে না।'' তবে সত্য কী? কবির ব্যাখ্যা, অভিজ্ঞতা থেকে খোঁজ মেলে পরম সত্যের। কৌতূহলী হয়ে ওঠেন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী। তাহলে মানুষের জ্ঞানগম্যিই সব? রবীন্দ্রনাথ বলেন, ''এটা শাশ্বত। কর্ম ও আবেগ দিয়ে তা অনুভব করি। নিজেদের সীমার মধ্যে থেকে লাভ করি অসীমকে। ব্যক্তিসত্ত্বা নিয়ে আদৌ ভাবিত নয় বিজ্ঞান। ধর্ম এই শাশ্বত সত্যকে উপলব্ধি করে সত্ত্বার চেতনার সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটায়।''
বিজ্ঞানের চিরাচরিত যুক্তি দিয়ে সত্যের অবলোকন করা যাবে না, তাও বুঝিয়ে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। আকর করছেন ভারতীয় দর্শনকে। তাঁর মতে, ভারতীয় দর্শনে পরম সত্য হল ব্রহ্ম। তা কোনও শব্দ বা ব্যক্তিগত ধারণার গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়। বরং অসীমের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েই ব্রহ্মের হদিশ পাওয়া সম্ভব। তবে এই সত্য উদ্ধার বিজ্ঞানের কর্ম নয়। আমরা যে সত্য নিয়ে কথা বলছি, তাকে মায়া বলা চলে।
কবি বোঝাতে চাইছেন, দর্শনই সত্য নয়। আত্মোপলব্ধিই সত্য। তার জন্য যেতে হবে অন্তরের অন্তঃস্থলে। তাই তিনি লিখেছেন, ''তোমার অন্তরতম পরম জ্যোতির মধ্যে দেখি, আপনার আত্মার স্বরূপ।''
আরও পড়ুন- 'তখন কি মা চিনতে আমায় পারো'--শিশুকবিতার এই চরণই যেন চিরসত্য রবিজীবনে!