নেই ভিটে-মাটি, নেই নাগরিকত্ব, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ‘অথৈ জলে’ এই উপজাতি!
এই উপজাতির মানুষরা কেউই নিজেদের বয়স সম্পর্কে কিছুই জানেন না। ভয়ঙ্কর সুনামিতেও এঁদের কোনও ক্ষতি হয়নি। কোথায় থাকেন এঁরা, কী ভাবে কাটে এঁদের জীবন? জেনে নিন...
নিজস্ব প্রতিবেদন: জল-ই জীবন। তবে কি আপনি সারা জীবন জলের মধ্যে থাকতে পারবেন! যেমন জলেই জন্ম আর জলেই মৃত্যু। মানে গোটা জীবনটা জলের উপর ভেসে কাটিয়ে দেওয়া। কল্পনা জগতে হয়তো বিষয়টা দারুন রোমহর্ষকর, তবে বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে এমন ভাবে সামান্য কয়েকটা দিন কাটানো মানে, এক বিভীষিকা। তাই নয় কি! তবে সত্যিই এমনই এক উপজাতি আজও পৃথিবীতে রয়েছে, যাঁদের জীবন জলেই কেটে যায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগর সংলগ্ন বিস্তীর্ণ জলরাশিতেই বসবাস এই উপজাতির।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল এই যে, এরা জলের নীচে কোনও রকম প্রযুক্তির সাহায্য ছাড়াই কাটিয়ে দিতে পারে প্রায় ১৩ মিনিট যা পৃথিবীর অন্য কোনও মানুষের পক্ষে মোটেই সম্ভব নয়। এরা হল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার, বিশ্বের সর্বাধিক দক্ষ সাঁতারু উপজাতি ‘বাজাউ’। এরা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জলেই বাস করেন। সমুদ্রে বসবাসরত এই উপজাতির সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। কাঠের নৌকতেই কাটছে এঁদের অবিরাম ভাসমান জীবন।
সবচেয়ে অবাক করার মতো বিষয় হল, এই উপজাতিরা কোনও দেশের নাগরিক নন। পৃথিবীর মূল ভূখণ্ডে অবাঞ্ছিতের মতো এরা নাগরীকত্বের সমস্ত অধিকার ছাড়াই যুগ যুগ ধরে অথৈ জলে কাটছে ‘বাজাউ’ উপজাতির জীবন। সমুদ্র শিকারের দক্ষতা থাকার ফলে এরা বেঁচে আছে। নৌকতেই কাটছে এদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম, নেই কোনও শিক্ষা, নেই কোনও সভ্য সমাজের সানিধ্যের সুযোগ। নাগরিকত্ব না থাকায় মেলে না কোনও সরকারী সুবিধাও। জলে ঘুড়ে ঘুড়ে কেটে যায় এদের জীবন। তাই এদের বলা হয় ‘সি জিপসি’ বা ‘সি নোম্যাড’।
সমুদ্রের অগভীর এলাকায় সমুদ্র তটে বাজাউ-রা তৈরি করেন অস্থায়ী ঘর। এই ঘরগুলো এমনভাবেই তৈরি করা যাতে কয়েক মুহূর্তে তা আবার খুলে ফেলা যায়। ২০০৪ সালে ভয়ঙ্কর সুনামি এই বাজাউদের কোনও ক্ষতি করতে পারেনি। ঘরের নিচ দিয়ে চলে গিয়েছিল প্রকৃতির ভয়ঙ্কর তাণ্ডব। আরও আশ্চর্যের বিষয় হল বাজাউরা তাঁদের নিজেদের বয়স জানে না। কারণ, শিক্ষার আলো এই উপজাতির উপর কখনোই পড়েনি। রাতের অন্ধকার কাটাতে আজও তাঁরা ব্যবহার করে মাছের চামড়া বা তেল দিয়ে তৈরি মশাল। সমুদ্র সংলগ্ন বেশ কিছু গ্রাম এদের মাছের বিনিময়ে জ্বালানীর কাঠ এবং জামা কাপড় দেয়।
একদল গবেষক বাজাউদের নিয়ে গবেষণাও করেছেন। তাঁদের ডিএনএ পরীক্ষা ও তাঁদের শ্বাসযন্ত্রের আলট্রাসোনগ্রাফি করা হয়। তাতে পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, বাজাউদের প্লীহা সাধারণ মানুষের প্লীহার তুলনায় কয়েক শতাংশ বড়। আর এই পার্থক্য থাকার কারণেই তাঁরা জলের নীচে বেশ কিছুটা সময় কোনও রকম যান্ত্রিক সাহায্য ছাড়াই কাটিয়ে দিতে পারে। সাধারণ মানুষের তুলনায় এদের ডিনএ-গত কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এদের শরীরে কার্বনিক অ্যানহাইড্রেজ নামে এক বিশেষ এনজাইম তৈরি হয়, যা এনজাইমটি রক্তস্রোতে খুবই ধীরে কার্বন-ডাই অক্সাইড পাঠায়। ফলে শ্বাস ধরে রাখতে সাহায্য দীর্ঘ সময় সাহায্য করে। এর ফলেই প্রকৃতির নিয়মে হোক বা শারীরিক অদ্ভুত পরিবর্তনের ফলে দিনের পর দিন জলেই জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে এই উপজাতি যা স্বপ্নেও ভাবতে আমাদের ভয় লাগবে! এই গোষ্ঠী বাস্তবেই এমন জীবন কাটাচ্ছে।