পুজোয় বেড়ানো--কাটোয়ার সিঙ্গি গ্রাম

Updated By: Oct 26, 2016, 03:02 PM IST
পুজোয় বেড়ানো--কাটোয়ার সিঙ্গি গ্রাম

'The Fair and Open Face of Heaven"

দুপাশে দিগন্ত বিস্তৃত ধানের খেত। সবুজ,ঝাড়ালো সব ধানগাছের গোড়া।  সবুজের আবার নানা রকমফের। কোথাও ঘন সবুজ, কোথাও কালচে সবুজ, কোথাও একটু সোনালির ছিটে।  কোথাও বা আবার ধান পেকে দেখা মিলছে সোনালি ফসলের। শরতের হাওয়ায় দুলছে অবিরত। যেন সবুজ সমুদ্র। মাথার ওপর কোথাও আকাশ ঢেকেছে কালো মেঘে। কোথাও মেঘের স্তর একটু পাতলা। কোথাও মেঘের স্তর ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়েছে নীল আকাশ। নীচে দিগন্ত জোড়া ধানখেত, মাথার ওপর আংশিক মেঘে ঢাকা আকাশ ভেসে যাচ্ছে শরতের সোনালি রোদে। কোথাও বা হঠাত্‍ই ঝমঝম করে নেমে আসছেএক পশলা বৃষ্টি। শরতের মেঘের মতই হঠাত্‍ হঠাত্‍ সেই বৃষ্টিধারা যাচ্ছে হারিয়ে। এসবের মাঝখান দিয়ে কালো পিচের মসৃণ রাস্তা চিরে ঝড়ের মত এগোচ্ছে আমাদের গাড়ি। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ছাড়িয়ে , বর্ধমান শহর পেরিয়ে, আমরা চলেছি কাটোয়ার দিকে। লক্ষ্য সিঙ্গি গ্রাম।
সবুজ সমুদ্রে পেরিয়ে বেলা প্রায় বারোটা নাগাদ পৌছে গেলাম সিঙ্গি গ্রামে। কাটোয়া দুই ব্লকের আওতায়এই গ্রাম। বহুদিনের পুরনো , সমৃদ্ধ গ্রাম। রাস্তার ধারে তিনতলা লজ শান্তিনিকেতন। সম্রাট আর সুদেষ্ণার হোম স্টে। কলকাতা থেকে খবর নিয়ে এসেছি নবমী আর দশমী নিশ্চিন্তে এখানে কাটাব বলে।

সুইট হোম টু হোম স্টে
লজে ঢুকতেই হাতে বরফের টুকরো দেওয়া সরবতের গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে সম্রাট, সুদেষ্ণা, ওদের বারো বছরের মেয়ে বিংগো আর লজের কর্মীরা। সত্যিই,  ঠাণ্ডা সরবতে একটা চুমুক দিয়েই যেন জুড়িয়ে গেল শরীরটা। তিনতলায় উঠে আরওএক চমক। পাশাপাশি তিনটে ঘর, পোস্ত, সরষে আর মণ্ডা। ঘরের মধ্যে আছে আরামের সব উপকরণ। প্রশস্ত, সুসজ্জিত বিছানা, দ্রুতগামী ফ্যান, আলোকিত জানালা, মানানসই মাপের বড় বাথরুম, ফোয়ারা, গিজার, তোয়ালে , সাবান। আরামের উপকরণের ঘাটতি নেই।
আর ঘরের সামনে অন্ত দশফুট বাই কুড়ি ফুট খোলা ছাদ। ছাদের চারদিকে আদিগন্ত সবুজ ধানের খেত। এত ওপর থেকে দূরে দেখলে চোখে যেন ঘোর লাগে। এখন দুপুর। গরম আছে বেশ। তবু বইছে একটা ঝিরঝিরে হাওয়া। জুড়িয়ে যাচ্ছে শরীরটা। দ্রুত স্নান সেরে ফেলতে হল। তারপর  মধ্যাহ্নভোজের পালা। ঝরঝরে সাদা ভাত আর  কচি পাঁঠার ঝোলে জমে গেল নবমীর দুপুরের ভুরিভোজ। এরপর জমিয়ে ঘুম।

হারিয়ে যাওয়া পুজো

 সন্ধে নামতেই গ্রামের পুজো দেখার পালা। এ এক অন্যরকম অনুভূতি। ছোট ছোট মণ্ডপ। একেবারে ঘরোয়া ছাঁদের প্রতিমা। প্রতিটি প্রতিমার মুখ যেন চেনাজানা। একটা-দুটে ঢাক বাজছে। মাইকের উত্‍পাত নেই। মণ্ডপে অল্প কিছু লোকজনের সমাগম। তাঁদের মধ্যে বয়স্কা মহিলারাই বেশি। পুজোয় শ্রী ও সমৃদ্ধির ছাপ রয়েছে। তবে অকারণ প্রাচুর্যের আড়ম্বর নেই। দেখলে ছোটবেলায় ফেলে আসা পুজোর দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। কত আড়ম্বরহীন, কত আন্তরিক ছিল সেসব পুজো। বাঙালির নগরজীবন থেকে কবেই বিদায় নিয়েছে সেই সব দিন।

ইতিহাসের শ্রীবাটি
পরদিন দশমী। সকালে গেলাম সিঙ্গি গ্রাম থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরের শ্রীবাটি গ্রামে। অত্যন্ত সমৃদ্ধ গ্রাম। আজ থেকে আড়াইশ-তিনশ বছর আগের কথা। ব্যবসার জন্য বাংলার উপকূলে তখন আসতে শুরু করেছে পর্তুগিজরা। হুগলিতে ঘাঁটি গেড়েছে তারা। জমে উঠেছে বাণিজ্য। সেই সময় নুনের ব্যবসা করতে গুজরাত থেকে বাংলায় ঘাঁটি গেড়েছিলেন একদল ব্যবসায়ী। প্রায় তিন শতাব্দী পেরিয়ে আজ তাঁরাই গন্ধবণিক চন্দ্র হিসাবে পরিচিত এই বাংলায়। কাটোয়ার গঙ্গার ধারে লবণগোলাই ছিল এঁদের ব্যবসার কেন্দ্র। এক সময় জমি জায়গা কিনে শ্রীবাটি গ্রামেই স্থায়ী হয়েছিলেন তাঁরা। শুরু করেন দুর্গাপুজো। তিনশ বছরেরও পুরনো পুজো আজও চালু রয়েছে শ্রীবাটির চন্দ্রবাড়িতে। আর এই বাড়ির পাশেই রয়েছে বিষ্ণুপুরের টেরাকোটা মন্দিরের আদলে তিনটি শিবমন্দির। মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার কাজ আজও অক্ষত। সেইসব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মূর্তির কী অপরূপ ভঙ্গিমা, কী নিখুঁত মুখশ্রী। অথচ অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে সেই সব মন্দির। হেলদোল নেই আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার।

সিঙ্গি ও কাশীরাম দাস
পরের চমক মহাকবি কাশীরাম দাসের বসতবাটি। মধ্যযুগে সিঙ্গি গ্রামেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন কমলাকান্ত দাসের অন্যতম পুত্র কাশীরাম দাস। পরে আদ্যন্ত সংস্কৃতে লেখা মহাভারত মহাকাব্যকে বাংলা পয়ার ছন্দে অনুবাদ করেছিলেন তিনি। সিঙ্গি গ্রামে তাঁর নামে রয়েছে একটি লাইব্রেরি। একতলা লাইব্রেরি ভবন তৃণমূল সরকারের আমলে সংস্কার হয়েছে। তবে বেহাল দশা বইপত্রের। কথিত আছে, লাইব্রেরির ধারেই যে পুকুর, তার পাশে গাছের ছায়ায় বসে মহাভারত রচনা করেছিলেন মহাকবি কাশীরাম দাস। তবে দুঃসহ অবস্থা কবির ভিটের। সরকারি উদ্যোগে সেখান রয়েছে বটে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র। কিন্তু বাড়ির অবস্থা জরাজীর্ণ। লাগোয়া জমির ঝোপঝাড়ে সাপ থাকা বিচিত্র নয়। জমি নিয়ে মামলার জেরে বহুকাল সংস্কার হয়নি কবির ভিটের।
সব মিলিয়ে অহংকার আর হাহাকারের সুর পাশপাশি বাজে কবির ভিটে দেখার পর। হাহাকার এজন্য যে কালের গর্ভে বিলীন হতে বসেছে তাঁর ভিটে বাড়ি। তবে কাশীরাম দাসের মহাভারত তো আজও বাংলার ও বাঙালির অন্যতম আইডেন্টিটি।  সেই অহংকার  উজ্জীবিত করে আপামর বাঙালিকে।  

দিনশেষে সোনালিবেলায়

দশমীর দিন বেল চারটে নাগাদ রওনা হলাম গাড়িতে। এবার লক্ষ্যে কাটোয়ার গঙ্গার ঘাট। সেখানে দেখব নিরঞ্জন পর্ব। ঘূর্ণাসুর উধাও। আকাশে পেঁজা তুলোর মত মেঘ। তাতে শরত্‍শেষের অপরাহ্নের আলো ঠিকরে চারপাশ ভরে উঠছে এক মায়াবি আলোয়। কালো পিচঢালা রাস্তা দিয়ে প্রায় যেন পিছলে যাচ্ছে গাড়ির চাকা। হঠাত্‍ই আমরা নির্বাক। রাস্তার ডানদিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে দীর্ঘ কাশের গুচ্ছ । একটানা। মাইলের পর মাইল।  দুলছে মৃদু হাওয়ায়। শ্বেতশুভ্র কাশের গুচ্ছে সোনালি  রোদ পড়ে কীসে যেন একটা ভরিয়ে তুলেছে চার পাশ। কথায় প্রকাশ করা যায় না এমন একটা অপার্থিব সৌন্দর্য। আমরা চিত্রার্পিত। দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেলাম কাশের জঙ্গল। ক্যামেরা খোলার কথা কারো মাথাতেই এল না।
মুগ্ধতা বোধ কাটতে না কাটতে এসে পড়লাম কাটোয়া। টোটোয় চেপে সোজা গঙ্গার ঘাট। সেখানে অপেক্ষা করছিল আরেক চমক। নৌকো কিছুটা এগোতেই দেখা গেল সঙ্গম। বীরভূম থেকে অজয় এসে মিশেছে ভাগীরথীতে। ওপাড়ে মাইলের পর মাইল কাশের বন নুয়ে পড়ছে গঙ্গার হাওয়ায়। তাতে শেষ বিকেলের সোনা রোদ উঠছে ঝলমলিয়ে। ক্রমশ কমে এল বিকেলের আলো। একটু একটু করে ঝাপসা হয়ে এল চারদিক। আলো অন্ধকারের মধ্যে পূব আকাশে দেখা গেল দশমীর চাঁদ। তার হাল্কা আলো ছড়িয়ে পড়ল অন্ধকার গঙ্গার বুকে। ওদিকে তখন মহাউদ্ধারণপুরের ঘাটে লকলকিয়ে উঠছে চিতার আলো। এদিকে গঙ্গার আরেক ঘাটে বাজছে বিসর্জনের বাজনা। একে একে ভাগিরথীর স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে সোনার দুর্গাপ্রতিমা। আমাদের নৌকা কিন্তু থেমেই নেই। চাঁদের আলোয় ম্লান ভাগিরথীর স্রোত ভেঙে বহে চলেছে নৌকা। শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে?

 

.