অসম থেকে ফিরছি, পর্ব ৩
অন্যান্য ইস্যুতে তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেস সংসদে এক হয়ে লড়লেও এনআরসি-র পাশেই থাকবে কংগ্রেস। কিন্তু, যেসব প্রকৃত হিন্দু ভোটাররা বাদ পড়েছেন, তাঁদের পাশেই থাকছে কংগ্রেস। জনগণকে এমন বার্তাটাই দিতে চাইছে তারা।
কমলিকা সেনগুপ্ত
অসম কার? আটের দশক থেকে এই দ্বন্দ্ব চলছে। আমাদের গাড়ি এবার মোড়েগাও এর দিকে। কলকাতায় বসে যাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম, তাঁদের মধ্যে ছিলেন বাঙালি সংগঠনের প্রতিনিধিরা। জানতে পেরেছিলাম, বাঙালি সংগঠনের দায়িত্বে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের নাম ওঠেনি। এবার মুরিগাও-এর এমন পরিবারগুলোর সঙ্গে দেখা করতেই যাচ্ছি। যাওয়ার পথে দু'টি রাজ্য পেলাম। আমাদের গাড়ি ছুটছে...একদিকে আসাম অন্যদিকে মেঘালয়।
মোড়েগাও পৌঁছে বুঝলাম, এখানেও অনেক বাঙালি। ছোট্ট ছোট্ট বেশ অনেকেগুলো দালান, যেমন আমাদের গ্রামে থাকে ঠিক সে রকমই সব বাড়ি। নামতেই দেখা হল বাঙালি ছাত্র ইউনিট-এর সচিব অজয় সরকারের সঙ্গে। দেখা হতে প্রথমেই হাত জোড় করলেন তিনি। একটু অবাক হলাম, হঠাচ্ এমন আচরণ কেন? অজয় বললেন "দিদি, বাঙালিরা আসামে বিপন্ন হয়েছে অনেকবার। কিন্তু কখনও সাহায্য পায়নি প্রতিবেশীদের থেকে। এই প্রথম মমতা দিদি আশ্বাস দিয়েছেন তাই ধন্যবাদ দিলাম"। আর অজয় এটাও বারবার বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে, ৪০ লাখ বাঙালি হিন্দুর সংখ্যাটা কিন্তু কম নয়। বরং এটাই বলাই যায় যে, বেশ বড় অংশের বাঙালি হিন্দুরা বিপন্ন।
অজয়ের নিজের পরিবারেও তিন জনের নাম ওঠেনি, উঠেছে কেবল একজনের নামই। বুঝলাম, এই সমস্যা বুঝতে গেলে রাজনীতির কারবারিদের সঙ্গে কথা বলতেই হবে। তাই পরের দিন অসাম রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণদের খেলোয়াড়দের সঙ্গে দেখা করবো। সেই অনুযায়ী লাইনআপ করলাম। আসামে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ-এর অ্যাপন্টমেন্ট নিলাম সবার আগে।
পাহাড় ঘেরা গুয়াহাটি শহরে খানাপাড়াতে থাকেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ। পাহাড়ের উপরে তাঁর বাড়ি এখনও আঁটো সাটো নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে। দীর্ঘকাল কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি ছিল এই অসম। কিন্তু, বিজেপি যে সব উল্টে পাল্টে দিয়েছে, তা তরুণ গগৈ-এর চেহারা দেখেই বোঝা যায়। আমরা যখন অপেক্ষা করছি সংসদে তখন কংগ্রেস-তৃণমূল নাগরিক পঞ্জির বিরোধিতায় সরব। স্বাভাবিক কারণে তাই প্রথম প্রশ্ন, অসমে নাগরিক পঞ্জি নিয়ে কংগ্রেসের কী অবস্থান? তরুণের স্পষ্ট জবাব, এনআরসি আমার বাচ্চা, কিন্তু এর রূপায়ন ঠিক হয়নি। আর বেশির ভাগ বাঙালি হিন্দুরা যে অসুবিধায় পড়ছে, সেটা আমাদের দেখতে হবে। কিন্তু বুঝলাম, এই ইস্যুকে মমতা 'হাইজ্যাক' করে কিছু করতে পারবে না বলেই তিনি মনে করেন। আরও বুঝলাম, অন্যান্য ইস্যুতে তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেস সংসদে এক হয়ে লড়লেও এনআরসি-র পাশেই থাকবে কংগ্রেস। কিন্তু, যেসব প্রকৃত হিন্দু ভোটাররা বাদ পড়েছেন, তাঁদের পাশেই থাকছে কংগ্রেস। জনগণকে এমন বার্তাটাই দিতে চাইছে তারা।
এরপরের গন্তব্য, প্রফুল্ল মোহন্ত। তাঁর আন্দোলনেই এনআরসি হচ্ছে, এমনটা বলা যেতেই পারে। আসুর আন্দোলনের জেরে সই হয়েছিল আসাম চুক্তি। গুয়াহাটি গেস্টহাউসে জেডপ্লাস নিরাপত্তার ব্ল্যাক কম্যান্ডো নিয়ে যখন ঢুকলেন অসম আন্দোলনের এই ডাকসাইটে নেতা, তাঁর চেহারাই বলে দিচ্ছিল কতটা প্রতাপ। আমাকে দেখে প্রথম প্রশ্ন, "কেন আপনাদের মুখ্যমন্ত্রী খোঁচাচ্ছে? আপনাদের ওখানে সমস্যা হলে আমরা যাই? এখানে কোনও ঝামেলা হচ্ছে না, সব শান্ত, উনি অশান্ত করছেন। যারা আমাদের ডেমোগ্রাফি বদলে দিচ্ছে, তারা কেন থাকবে এখানে"? আরও পড়ুন- অসম থেকে ফিরছি পর্ব ২: 'জোয়ানদের তুলে নিয়ে গেল পুলিস,' আশঙ্কার প্রহর নেলির রোজনামচায়
সরকার এনআরসি সঠিক মনে করছে। কংগ্রেস এনআরসি-র সঙ্গে আছে, বিরোধীরা বিরোধীতায় আছে । রাজনীতির ময়দানে নাগরিক পঞ্জি তাই এখন হট টপিক। তাই রাজনৈতিক নেতারা অভিযোগ পাল্টা অভিযোগে মেতে থাকবেনই। কিন্তু, আয়েব আলি, শেখর ওরা কী করবে, এই প্রশ্ন নিয়ে যেতেই হবে এনআরসি দফতরে। আরও পড়ুন- অসম থেকে ফিরছি পর্ব ১: নাম আছে? অসমজুড়ে একটাই প্রশ্ন