Durga Puja 2022, Wriddhiman Saha : আমার ছেলেবেলা, আমার দুর্গাপুজো, আমার ক্রিকেট প্যাশন
Durga Puja 2022, Wriddhiman Saha : আমার স্ত্রী রোমি এমনিতে একেবারে ঘরকন্যা। কিন্তু এই পুজোর মরসুম এলেই ওদের 'ঘুমন্ত' হোয়াটসআ্যপ গ্রুপ যেন জেগে ওঠে! ওই সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মত!
ঋদ্ধিমান সাহা
প্রাক্তন উইকেটকিপার, টিম ইন্ডিয়া
দুর্গাপুজো নিয়ে লিখতে বললেই ছোটবেলার গল্প মনে এসে ভিড় করে। ছোটবেলার গল্প তো সবাই লিখছে। এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে, বিশ্বজুড়ে তীব্র করোনা পরবর্তী পরিস্থিতির মধ্যে দুর্গাপুজোর নানান স্মৃতিকথা পড়ছি। কেউ কেউ ছবি-সহ পোস্ট দিয়েছেন। আশ্বিনের রোদ খাওয়াচ্ছেন আলমারিতে বন্ধ পড়ে থাকা জামাকাপড়কে। কেউ কেউ ক’টা শাড়ি হল তার পোস্ট দেন, কেউ লেখেন কোথায় বেড়াতে যাচ্ছেন। তবে আমার কাছে এই দুর্গাপুজো একদম অন্যরকম।
আমি ভারতীয় টেস্ট দলের প্রাক্তন উইকেটকিপার ঋদ্ধিমান সাহা। আমার বেড়ে ওঠা শক্তিগড়ে। বর্ধমানের নয়। শিলিগুড়ি শহরেও একটা শক্তিগড় আছে। ক্রিকেটের সুবাদে গত কয়েকবছরে সবাই আমাকে ঋদ্ধি নামে জানে। তবে এখনও পাড়ার কাকা-জ্যাঠা'রা আমাকে 'জন্টি' কিংবা 'পাপালি' নামেই চেনেন। ওই নামেই ডেকে থাকেন। জানেন শিলিগুড়িতে পা রাখার পর কেউ 'জন্টি' কিংবা 'পাপালি' নামে ডাকলে অদ্ভুত একটা ভাললাগা জন্মায়। যেন একপলকে সেই ছোটবেলায় ফিরে যাই!
আমার স্ত্রী রোমি এমনিতে একেবারে ঘরকন্যা। কিন্তু এই পুজোর মরসুম এলেই ওদের 'ঘুমন্ত' হোয়াটসআ্যপ গ্রুপ যেন জেগে ওঠে! ওই সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মত! আলোচনা শুরু হয় এই পুজোর দেওয়া-থোওয়া নিয়ে। কত কথা উঠে আসে। বাঙালির দুর্গাপুজো তো আসলে পরিবারে পরিবারে সব বয়সি মেয়েদেরই বন্দনা। তাদেরই আদর, তাদেরই আহ্বান। তবে আমি কিন্তু ঈশ্বরে বিশ্বাসী নই। যদিও এরকম ভাবেই ব্যাপারটা দেখি। পুরুষদের ভূমিকাটা এখানে অনেকটা কর্মকর্তাদের মত।
কিন্তু কাদের ঘিরে এত আয়োজন? এই নারী সমাজকে ঘিরেই। মঞ্চে যিনি উপবিষ্ট তিনিও নারী। তাঁকে ঘিরে উৎসব। আর উৎসবের কেন্দ্রে তাঁকে রেখে রক্তমাংসের নারীদেরই বন্দনা করা। এখানে বন্দনা মানে ‘প্যামপার’ ধরতে হবে। পুজোর কেনাকাটা মেয়েদেরই বেশি। উপহারের আশি শতাংশ মেয়েদেরই জন্য। বস্তুত, আমাদের তথাকথিত পুরুষ সমাজ থেকে মেয়েদের উপস্থিতি সরিয়ে নিলে আলো ঝলমলে আনন্দের পরিবেশ বলে আর কিছুই থাকে না। এই আনন্দই তো দুর্গাপুজোর আসল উপাচার, যা দিয়ে ধীরে ধীরে আমরা মাহেন্দ্রক্ষণের দিকে এগিয়ে যাই। এই করতে করতে এসে যায় মহালয়া আর শুরু হয়ে যায় আমাদের প্রিয় শারদীয়া। শুরু হয়ে যায় দেবীপক্ষ।
পড়ুন, বাঙালির প্রাণের উৎসবে আমার 'e' উৎসব। Zee ২৪ ঘণ্টা ডিজিটাল শারদসংখ্যা
তবে ছোটবেলা থেকে আমি কিন্তু দুর্গাপুজোর উত্তাপ তেমনভাবে নিতে পারিনি। প্যান্ডেল তৈরি হওয়ার সময় বাঁশের মাচায় চেপে চুটিয়ে খেলেছি। বাবা'র হাত ধরে ঠাকুর দেখাও হয়েছে। যদিও বড় হওয়া পর্যন্ত সেটা স্থায়ী হয়নি। কারণ, ক্লাস ফাইভ কিংবা সিক্সে পড়াশুনো করার সময় থেকেই জীবনে 'প্রেম' এসেছিল। পাড়ার কোনও মেয়ের সঙ্গে নয়। বরং ক্রিকেটের সঙ্গে। দুরন্ত ফিল্ডিং, অফ স্পিন বোলিংয়ের পাশাপাশি মারকাটারি ব্যাটিং সঙ্গে দুর্ধর্ষ কিপিং। ছোট থেকেই ছিলাম একেবারে 'কমপ্লিট প্যাকেজ'। তাই তো পাড়ার সিনিয়রদের দল থেকে শুরু করে জয়ন্ত ভৌমিকের (পড়ুন আমার ছোটবেলার কোচ ও গুরু) কোচিং সেন্টার, সর্বত্র আমার ব্যাপক ডিমান্ড ছিল। পড়াশোনায় খুব খারাপ ছিলাম না। কিন্তু ওই মাঠে খালি পায়ে কিংবা কেডস গলিয়ে গা ঘামনোর নেশা আমাকে খুব ছোটবেলায় শিলিগুড়ি থেকে কলকাতায় এনে ফেলল। ব্যাস আমার দুর্গাপুজোর প্রতি প্যাশন'ও যেন অচিরেই কমে যেতে শুরু করল। লেখাপড়ার ল্যাটা তো অনেক আগেই চুকে গিয়েছিল। আমার কাছে প্রথম প্রেম হয়ে উঠল ক্রিকেট।
জানেন তো বাঙালির জীবনের একটা অদ্ভুত দিক আছে। একজন বাঙালির জীবনটা কেমন চলছে, কেমন কাটছে, দুর্গাপুজো এলে এর একটা পরিষ্কার ছবি পাওয়া যায়। কোন মানসিক, আর্থিক, শারীরিক, পারিবারিক অবস্থায় একজন বাঙালি রয়েছেন, তা বোঝা যায় দুর্গাপুজোর সময়। এই সব কিছু যদি মোটামুটি ঠিকঠাক থাকে তা হলে বাঙালি দুর্গাপুজোর ঢালাও আনন্দের স্রোতে এলোপাথাড়ি হাত-পা ছুড়বেই। সাজবে। গুজবে। দন্ত বিকশিত করে হাসবে। যে খাবার খেয়ে হজম করতে পারে না, দলে পড়ে তাই খাবে। খেয়ে রাতে গলা বুক জ্বলা নিয়ে ছটফট করবে। যতটা হাঁটলে পায়ের কলকব্জা খুলে যায় ততটা হাঁটবে। দু’মাইল লাইনে দাঁড়িয়ে ঠিক মণ্ডপের সামনে পৌঁছে বলবে, 'এ বার আমি অজ্ঞান হয়ে যাব। আমার আর ঠাকুর দেখে কাজ নেই। চল বাবা ফিরে যাই। মানুষ আসে এই ভিড়ে!' হয়তো বা কানমূলে বলবে, 'এই শেষ, আর জীবনেও আসছি না।' বলে আবার পরের দিন আবারও মাঞ্জা মেরে বেরবে। আরও নানান খাবারের চিন্তা মাথায় নিয়ে। বেরিয়ে দু’ঘণ্টা ট্রাফিকে আটকে বসে বলবে, 'এত মানুষ বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়? ভগবান, লক্ষ লক্ষ মানুষ।'
ওই যে বললাম, এক জন কেমন আছে সেটা তাঁর দুর্গাপুজো পালন করা দেখলেই ধরে ফেলা যায়। কোনও মানুষ যখন ব্যক্তিজীবনে তীব্র নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন, তখন তাঁর দুর্গাপুজো কাটে একেবারে অসামাজিক ভাবে। হয়ত টাকাপয়সা অত নেই, মনের মধ্যে একটা নিরাপত্তাহীনতার শক্তপোক্ত বোধ আছে, সে কিন্তু খুব আনন্দের সঙ্গে দুর্গাপুজো পালন করতে পারবেন না।
আরও পড়ুন: IND vs SA : জাতীয় দলে বাংলার শাহবাজ, এখনও কোভিড আক্রান্ত শামি, দলে উমেশ-শ্রেয়স
আমাদের পুরনো পাড়ায় শান্তি মাসি বলে এক জন ছিলেন। তাঁর কেউ ছিল না। বিধবা, নিঃসন্তান। পাঁচিল ঘেরা বাড়িতে একা থাকতেন। সাদা থান পরতেন। সর্বত্র খালি পায়ে হেঁটে চলে বেড়াতেন। তবে পুজোর ওই পাঁচটাদিন সেই মানুষটার যে কোন পর্যায়ে সামাজিক ইনভলভমেন্ট ছিল ভাবা যায় না! দুর্গাপুজোর সময় দুঃস্থ মানুষদের ডেকে এনে পেট ভরে ভোগ খাইয়ে, সেই এঁটো শালপাতা ফেলানোর তদ্বির তদারকিতেও তো তাঁর পাঁচদিন হইহই করে কেটে যেত। আবার এমন মানুষ দেখেছি, একমাত্র ছেলে বিদেশে চলে গিয়েছে। আর ফিরে আসেনি। পুরো পুজো তাদের সমস্ত বাড়ি অন্ধকার। কেউ ডাকলেও ভেতর থেকে সারা নেই। সারা বছর যে শোক চোখে দেখা যায় না, দুর্গাপুজোর সময় সেই শোক আরও প্রকট হয়ে ধরা পড়ে।
আমার যেমন পুজো ভাল-মন্দের মধ্যেই কেটেছে। ভারতীয় দলে খেলার সময় বেশিরভাগ সময় পুজোর মধ্যেও কোনও না সিরিজ খেলেছি। বেশ কয়েকবার বাংলার হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার জন্যও অন্য রাজ্যে থাকতে হয়েছে। ফলে পুজোটা পরিবারকে ছাড়াই কাটাতে হয়েছে। তবে পুজোর সময় কলকাতায় থাকলেও বউ ও ছেলে-মেয়েকে নিয়ে খুব একটা বেরোনো হয় না। আমার বাবা-মা কিংবা শ্বশুর-শ্বাশুড়ি একেবারে দল বেঁধে বেরিয়ে পড়েন। আমি তখন প্লে-স্টেশন খেলে ও গুজরাটি খাবার খেয়ে দিব্যি সময় কাটাই। এ বার তো আবার পুজোর সময় সৈয়দ মুস্তাক আলি ট্রফি চলবে। সেইজন্য জয়পুরে আছি। পুজোর পর বাড়ি ফিরব। ছেলেটাও একেবারে ছোট। মাত্র দুই বছর ছয় মাস বয়স। মেয়েটা বড় হচ্ছে। তাই ওদের জন্য মন কেমন করছে। কিন্তু কী আর করব বলুন, পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে এটা মেনে নিতেই হবে।
যদিও কয়েক বছর আগে শিলিগুড়িতে দুর্গাপুজো কাটিয়েছিলাম। দশমীর বিকেলে ঠাকুর পরিক্রমা ও বিসর্জনের দৃশ্য ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখছি। সকালের দিকে পাড়ার মহিলাদের সঙ্গে রোমি চুটিয়ে সিঁদুর খেলায় মাতল। ওকে ভারী সুন্দরী লাগছিল। মন্ডপ জুড়ে ঢাক বাজছে। সবাই ধুনুচি নাচ নাচছে। আর একটা চক্কর, তার পরই মা দুর্গা বিদায় নিয়ে চলে যাবেন পাড়ার মানুষদের থেকে। আমার কন্যা আনভি আমার পাশে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। হঠাৎ আমি ওর দিকে তাকিয়ে দেখি, ওর চোখ ছলছল করছে। অপরূপ সৌন্দর্য সেই মুখে, শুধু ত্রিনয়নটাই যেন নেই! আমি কিছু বলার আগেই ও বলে উঠল, 'আচ্ছা বাবা আমি যে দিন চলে যাব তুমিও কি এভাবেই কাঁদবে!'
আমি খুব শক্ত মনের ছেলে। বিশ্বাস করুন সে দিন চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি। আদর করে জড়িয়ে ধরে একটাই কথা বলেছিলাম, 'আসছে বছর আবার আসবি মা।'
আমি নাস্তিক। শুধু মূর্তি পুজো কেন কোনও ধরনের পুজোয় বিশ্বাসী নই। তবে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই দুর্গাপুজোর মধ্যে একটা শিল্প খুঁজে পাই। সেটাই মন দিয়ে দেখি। তবে আনভি'র ওই কথাগুলো আজও কানে বাজে। কথাগুলো মনে পড়লেই যেন মা দুর্গার মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এই দেখলেন দুর্গাকে 'মা' বলে ফেললাম!
(সাক্ষাৎকার ভিত্তিক লেখা। অনুলিখন : সব্যসাচী বাগচী)