অর্কদীপ্ত মুখোপাধ্যায়: ছ'বারের গ্র্যান্ড স্লাম জয়ী সানিয়া মির্জা কেরিয়ারের চতুর্থ অলিম্পিক্সে অংশ নিতে চলেছেন টোকিওতে। তিনি এবার তরুণ খেলোয়াড় অঙ্কিতা রায়নাকে বেছে নিয়েছেন পার্টনার হিসেবে। জাপান উড়ে যাওয়ার আগে সানিয়া কথা বললেন জি ২৪ ঘণ্টার সঙ্গে। রইল এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার।
প্রশ্ন: সাইনি উইলসনের পর আপনি ভারতের দ্বিতীয় মহিলা অ্যাথলিট হিসেবে চতুর্থ অলিম্পিক্স খেলতে যাচ্ছেন। কতটা স্পেশাল এই অলিম্পিক্স আপনার জন্য?
সানিয়া: অবশ্যই আমার জন্য এটা খুবই স্পেশাল। কেউ যদি আমায় কেরিয়ার শুরুর আগে বলত যে, আমি ৪টি অলিম্পিক্স খেলব, তাহলে সেটা আমার কাছে স্বপ্নের মত হত। তাই আমার কাছে এটা খুবই গর্বের। আমি নিজেকে নিয়ে গর্বিত কিন্তু একই সঙ্গে আমি কৃতজ্ঞ যে অলিম্পিক্সের মত ইভেন্টে আমি ফের আমার দেশের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাচ্ছি। আমি খুবই আনন্দিত।
প্রশ্ন: মা হওয়ার পর কতটা কঠিন সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলা? আপনি ইতিমধ্যেই কর্মরতা মায়েদের জন্য অনুপ্রেরণা।
সানিয়া: কঠিন তো অবশ্যই। শুধু খেলা নয়, কর্মরতা মায়েদের জন্য জীবনে সবকিছু ব্যালান্স করা খুবই কঠিন। বাচ্চা যখন ছোট থাকে তখন মায়ের সঙ্গেই বেশি একাত্ম থাকে এবং সেই সময়েই ভারসাম্য আনা খুব প্রয়োজন। এই ব্যালান্সটা তখনই পাওয়া যায় যদি পরিবারের সদস্যরা আপনার সঙ্গ দেয়। একইসঙ্গে একটা ভালো টিমও থাকা জরুরি যারা আপনাকে সাপোর্ট করবে, উত্সাহ দেবে। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে এই ধারণা রয়েছে যে যখন একজন মহিলা মা হয়ে যায় তখন ধরে নেওয়া হয় যে তার কেরিয়ার শেষ ও তাঁর একমাত্র কাজ ২৪ ঘণ্টা বাচ্চার খেয়াল রাখা। কিন্তু নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য কেউ যদি চেষ্টা করে যায় তাহলে সেটা কাউকে খারাপ মা প্রতিপন্ন করে না। বরং ভবিষ্যতে বাচ্চাকে আরও বেশি অনুপ্রাণিত করবে যে, তাঁর মা নিজের স্বপ্নও পূরণ করেছেন এবং ভালো মা-ও হয়েছেন। এই বার্তাই আমি সবসময় দিতে চেষ্টা করেছি। শুধু মুখের কথা নয়, কাজের মাধ্যমেও তা করতে হবে। নিজের স্বপ্নকে সত্যি করার চেষ্টা করলে সন্তান ভবিষ্যতে আরও বেশি সম্মান করবে। কোনও কিছুতে সেরা হতে গেলে বা সেরা হওয়ার চেষ্টা করলে কাজটা কঠিন। যতটা পরিশ্রম ঘরে করতে হয় ততটাই বাইরে করতে হয়। এই জায়গাতেই ব্যালান্স খুঁজতে হয়।
প্রশ্ন: এতদিন পর উইম্বলডনের মত বড় টুর্নামেন্টে ফিরে নিজের খেলায় আপনি কতটা খুশি? বিশেষ করে মা হওয়ার পর ফিরেছিলেন আপনি।
সানিয়া: দেখুন, হেরে যাওয়ার পর আমি কখনও খুশি হই না। আমি টানা খেলছি না এতদিন পরে খেলছি, সেটা বিবেচ্য নয়। একজন অ্যাথলিট হিসেবে আমার ভিতরে এই ধারণা রয়েছে যে আমায় প্রত্যেকটি ম্যাচ জিততে হবে। শুধু আমি নয়, প্রতিটি অ্যাথলিটের মধ্যেই এটা থাকে। কিন্তু অপরদিক দিয়ে ভাবলে এটা ভাল যে, আমি বেশ কিছু ম্যাচ খেলতে পেরেছি। প্রায় ৪ বছর পর আমি গ্র্যান্ড স্লাম খেললাম। এটা খুবই আনন্দের যে প্রথম ম্যাচে যে টিমকে আমরা হারিয়েছি, তারা উইম্বলডনের অন্যতম সেরা দল ছিল। এখন যদি আমি কিছু টুর্নামেন্ট খেলতে পারি, তাহলে আমি সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলার জন্য আরও তৈরি হতে পারব। আমার বিশ্বাস আছে যে আমি সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলতে পারি তাই আমি টেনিস খেলছি। আমি নিজে একজন পারফেকশনিস্ট। তাই আমি জিতলেই একমাত্র খুশি হই। তবে উইম্বলডনে ম্যাচগুলো খেলা আমার জন্য ভালো হয়েছে এবং আরও কিছু ম্যাচ আমি খেলতে চাই এরপর।
প্রশ্ন: আপনি যখন কামব্যাকের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখনই করোনা অতিমারী নাড়িয়ে দেয় বিশ্বকে। সেই সময় দাঁড়িয়ে প্রস্তুতি নেওয়া কতটা কঠিন ছিল?
সানিয়া: কঠিন ছিল, এখনও কঠিন আছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অতিমারী এখনও শেষ হয়ে যায়নি। মা হিসেবে ব্যাপারটি আরও কঠিন। সন্তানকে নিয়ে সব জায়গায় যাওয়া সহজ নয়, অনেক ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় যেতে হয়, ফ্লাইটে যেতে হয়। আমি সাবধানী বলেই হয়ত সব জায়গায় খেলতে যাইনি, আমাকেও দেখতে হয়েছে কোন জায়গাটা নিরাপদ, কোনটা নয়। ইজহান খুব ছোট তাই ওকে বেশিরভাগ জায়গাতেই আমায় নিয়ে যেতে হয়। খুব বেশী সময় ওকে আমি আমার থেকে দূরে রাখা সম্ভব নয়, রাখতেও চাই না। তবে কাজটা কঠিন, আশা করি আমরা খুব শীঘ্র এর থেকে বেরিয়ে আসতে পারব। অনেকদিন হয়ে গেছে, আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। আমি চাই খুব দ্রুত সব স্বাভাবিক হোক।
প্রশ্ন: বেশ কিছু ওয়ার্ম আপ টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়ে ভিসা নিয়ে আপনাকে সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। ইজহানকে ছেড়েও থাকতে হয়েছিল। কী হয়েছিল যদি বলেন।
সানিয়া: ইজহান ও আমার বোনের জন্য ভিসা পাওয়া যাচ্ছিল না। আমার বোন আমাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছিল। আমি সবকিছু চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু যখন আর কোনো উপায় ছিল না তখন আমায় প্রাক্তন ক্রীড়ামন্ত্রী কিরেন রিজিজুকে যোগাযোগ করতে হয়। উনি খুবই সাহায্য করেন আমায়। সাই, ইউএই অ্যাম্বাসাডর, লন্ডনের অ্যাম্বাসাডররা প্রত্যেকে অনেক সাহায্য করেছেন। এরা সবাই বা কিরেন রিজিজু সবসময় একটা ফোনের ওপারে ছিলেন। তারা সবরকমভাব চেষ্টা করার পর আমার বোন ও ছেলের ভিসা হয়। কিন্তু তারপরেও ওদের কোয়ারান্টিনে থাকতে হয়, যা সহজ ছিল না। ১০ দিনের জন্য একটা আড়াই বছরের বাচ্চাকে একটা ঘরে রাখা খুবই কঠিন। তবে সবথেকে কঠিন ছিল একই দেশে থেকেও ওকে আমার থেকে দূরে রাখতে হয়েছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত সব ঠিক হয়ে যায়। এইধরণের প্রতিকূলতার মুখে পড়তে হয়।
প্রশ্ন: টোকিওতে কী নিয়ে যাবেন ইজহানকে?
সানিয়া: না, টোকিওতে নিয়ম খুবই কঠিন। ওকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। ইজহান এখন ভারতেই থাকবে।
প্রশ্ন: লিয়েন্ডার বলেছেন টেনিসে ভারতকে পরবর্তী পদকের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আপনি এ বিষয়ে কিছু বলতে চাইবেন?
সানিয়া: হয়তো ঠিকই বলেছেন। এতগুলো বছরে আমরা কোনও পদক পাইনি, যেটা পেয়েছিলাম সেটাও অনেক বছর আগে। শেষবার আমরা পদক পাওয়ার দোরগোড়ায় ছিলাম কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাইনি। কিন্তু আমাদের ভালো কিছুর আশা করতে হবে এবং অপেক্ষা করতে হবে। সবকিছুই সম্ভব।
প্রশ্ন: অলিম্পিকে আপনার পার্টনার অঙ্কিতা রায়না। ওঁকে বেছে নিলেন কেন?
সানিয়া: অঙ্কিতা, একজন তরুণ প্রতিভাবান খেলোয়াড়। গত দুই-তিন বছরে খুব ভালো খেলছে। প্রত্যেক অলিম্পিকের মত আমার কাছে সুযোগ ছিল নিজের পার্টনার বেছে নেওয়ার। প্রত্যেক অলিম্পিকেই আমি সেই মুহুর্তের সেরা ব্যক্তিকেই বেছে নিয়েছি। আমার পরে সেরা যে মহিলা খেলোয়াড় দেশে ছিলেন, তাঁদেরকেই বেছে নিয়েছি। একইরকমভাবে অঙ্কিতাকে বেছে নিয়েছি। অঙ্কিতার র্যাঙ্কিং ১০০-এর আশেপাশে যা আগে যাঁদের সঙ্গে খেলেছি তাঁদের ছিল না। অঙ্কিতা গ্র্যান্ডস্ল্যাম খেলছে, সর্বোচ্চ পর্যায়ের টেনিসে অভিজ্ঞতা আছে যা ওঁকে সাহায্য করবে। এতবড় টুর্নামেন্টে যাওয়ার আগে এই অভিজ্ঞতা আমাদের কাজে লাগবে।
প্রশ্ন: গ্রাস কোর্ট থেকে হার্ড কোর্টে পরিবর্তন করা কতটা কঠিন? এরিনাতে আপনি তিনটি টাইটেল জিতেছেন। সেখানেই আবার খেলবেন। সেটা কি একটা সুবিধা?
সানিয়া: গ্রাস কোর্ট থেকে হার্ড কোর্টে পরিবর্তন করা খুব স্বাভাবিক। যারা উইম্বলডন খেলেছেন তারা প্রত্যেকেই অলিম্পিক খেলবেন। এটা আমাদের করতে হয়। তবে আমি যেখানে খেলব সেটা আমার পরিচিত, আপনি ঠিকই বলেছেন। তবে প্রত্যেকটা দিনই নতুন, প্রত্যেকটা ম্যাচই নতুন। তাই নতুন করে শুরু করতে হয়।
প্রশ্ন: আপনার ফিজিক্যাল ফিটনেস ও মানসিক ফিটনেস নিয়ে কিছু বলুন। অলিম্পিকের মত টুর্নামেন্টে যা খুবই প্রয়োজন।
সানিয়া: ফিজিক্যালি আমি একদম ঠিক আছি। কোনো ইনজুরি নেই। ছোটখাটো চোট লেগেই থাকে মানসিকভাবেও আমি একদম ঠিক জায়গায় রয়েছি।
প্রশ্ন: ্অলিম্পিক্সে কি এবার পদক পাওয়া সম্ভব?
সানিয়া: আশা করি সম্ভব হবে। এটাই বলতে চাই, আমি যখন খেলছি, তখন জেতার জন্যই খেলছি। নাহলে খেলা ছেড়ে দিতাম। তবে ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। আমি যাই করি নিজের ১০০ শতাংশ দেব।
প্রশ্ন: নতুন যারা টেনিস খেলতে চাইছেন, তাঁদের অনেককেই অতিমারীর জন্য বিপদে পড়তে হয়েছে। কী উপদেশ দেবেন তাদের?
সানিয়া: আমার উপদেশ সবসময়েই থাকে যে, খুব পরিশ্রম কর, লেগে থাক। বাইরের বিষয়ে মাথা দেওয়ার দরকার নেই। নিজের ১০০ শতাংশ দাও। যা করছ সেটাকে ভালোবাসো, নাহলে কোনোদিনই সেরা হতে পারবে না।
(Zee 24 Ghanta App দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)