বকশিগঞ্জে পদ্মাপারে নয়, এই হাট বসে কাটোয়া স্টেশন-ধারে; বেগুন-মুলো নয়, এখানে বিক্রি হয় শ্রম!
ভিন জেলা তো বটেই, ভিন রাজ্য থেকেও মানুষ এখানে আসেন শ্রম বিক্রি করতে। এই সব শ্রমিকেরা জব কার্ড, শ্রমিক কার্ড ইত্যাদি থাকা সত্ত্বেও নিজের জেলায় বা নিজের এলাকায় কাজ না পেয়ে বাধ্য হয়ে রোজগারের আশায় কাটোয়ার এই শ্রমিক হাটে আসেন।
সন্দীপ ঘোষ চৌধুরী: 'হাট বসেছে শুক্রবারে/বকশিগঞ্জে পদ্মাপারে।/জিনিস-পত্র জুটিয়ে এনে/ গ্রামের মানুষ বেচে কেনে।/ উচ্ছে বেগুন পটল মুলো,/বেতের বোনা ধামা কুলো'--এ আমরা সকলে জানি। হাট বলতে যেন এই ছবিই ভেসে ওঠে আমাদের মনে। কিন্তু এখানে যে হাটের কথা বলতে চলেছি, তা বকশিগঞ্জের পদ্মাপারের হাট নয়, আর এখানে উচ্ছে-বেগুন-পটল-মুলোও বিক্রি হয় না। এ হল শ্রমিকের হাট। বসে কাটোয়া স্টেশন সংলগ্ন এলাকায়। এই 'শ্রমিক হাটে' বিক্রি হয় শ্রম।
ভিন জেলা তো বটেই, ভিন রাজ্য থেকেও মানুষ এখানে আসেন তাঁদের শ্রম বিক্রি করতে। এই সব শ্রমিকেরা জব কার্ড, শ্রমিক কার্ড ইত্যাদি থাকা সত্ত্বেও নিজের জেলায় বা নিজের এলাকায় কাজ না পেয়ে বাধ্য হয়েই রোজগার করতে কাটোয়ার এই শ্রমিক হাটে আসেন। হাজির হন শ্রম বিক্রি করতে। প্রত্যেক বছরই এই হাট বসে। এবছরও বসেছে। বসেছে কাটোয়া রেল স্টেশন সংলগ্ন এলাকায়।
আরও পড়ুন: Basirhat: তৃণমূলের দলীয় বিবাদে গুলিবিদ্ধ কনস্টেবল, গ্রেফতার ৪১, উদ্ধার আগ্নেয়াস্ত্র
এই দৃশ্য গত ২০ বছর ধরে দেখছেন কাটোয়াবাসী। এই সময়টা গ্রামবাংলায় বর্ষার ফসল ওঠে। ধান কাটার জন্য শ্রমিক দরকার পড়ে। নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, এমনকি ঝাড়খণ্ডের কিছু কিছু এলাকা থেকেও প্রত্যেক বছরে অসংখ্য শ্রমিক তাঁদের শ্রম বিক্রি করে রোজগারের আশায় ভিড় জমান কাটোয়ার এই শ্রমিক হাটে। এবারেও করেছেন।
আগে এখানে ন্যারোগেজ রেল ট্র্যাক ছিল। এটি বর্ধমান-কাটোয়া লাইন। ৫৩ কিলোমিটার দীর্ঘ রেল সেকশনের বলগনা-কাটোয়া অংশটির বিদ্যুদয়ন এবং তার ব্রডগেজে রূপান্তরণের কাজ শুরু হয় ২০১০-এর পরে। কাজ শেষ করে ২০১৮ সালে লাইনটি জনসাধারণের জন্য নতুন করে খুলে দেওয়া হয়। সেই হিসেবে এই জায়গাটা ব্রডগেজ লাইনের আওতায় এসেছে বছরচারেক। কিন্তু তার আগে এই সেদিন পর্যন্ত এটি ন্যারেগজের আওতাভুক্তই ছিল। এই লাইনে ট্রেনের সংখ্যাও কম ছিল, যাত্রীও কম ছিল। স্টেশনের আশপাশে অনেক ফাঁকা জায়গা পড়েছিল। সেখানেই এতদিন ধরে শ্রমিকেরা ভিড় করেছেন। এখন জায়গা একটু কমেছে, তবে সেখানেই তাঁরা জমায়েত হচ্ছেন কাজের আশায়।
নিজেদের লোটা-কম্বল নিয়ে, কাস্তে ইত্যাদি নিয়ে কাজের আশায় ভোর থেকে বেলা তিনটে পর্যন্ত অপেক্ষা করেন তাঁরা। কাটোয়া ও কাটোয়া-সংলগ্ন গ্রামগুলি থেকে সম্পন্ন কৃষকেরা এসে হাজির হন এখানে শ্রম কিনতে। এ বছরও শ্রমিকরা এসেছে বিভিন্ন জায়গা থেকে। কয়েকশো শ্রমিক বসে আছেন কাটোয়া স্টেশনের ৭ নম্বর প্লাটফর্ম-লাগোয়া টিকিট কাউন্টারের সামনে।
Bardhaman: নেই কাজ জুটছেনা ভাত, তবুও গান গেয়ে চলেছেন বর্ধমানের দিনমজুর | Zee 24 Ghanta#zee24ghanta pic.twitter.com/9cn5JxG8KA
— zee24ghanta (@Zee24Ghanta) November 22, 2022
সকলেই কি কাজ পাচ্ছেন?
এখানে সমবেত হওয়া শ্রমিকদল বলছে, সামগ্রিক ভাবেই কাজ পাওয়ার বাজার খুব খারাপ। কাজ পাওয়ার আশায় মুর্শিদাবাদ থেকে আসা শ্রমিকরা জানাচ্ছেন, জব কার্ড থাকা সত্ত্বেও নিজের এলাকায় কাজ পাননি তাঁরা। রোজগারের আশায় বাধ্য হয়েই কাটোয়া এসেছেন। কিন্তু এখানেও শ্রম কেনার বাজারের অবস্থা খারাপই। হয়তো সারা দিন বসে থেকেও ক্রোতা জুটল না!
সারাদিন ধরে কাস্তেয় শান দিয়ে যাওয়াটা বিফলে গেলে কী করেন শ্রমিকেরা?
সারাদিন অপেক্ষা করেও শ্রম কিনতে আসা গেরস্তবাবুদের দেখা পান না অনেকে। অনেক সময় দেখা পেলেও হয়তো দরদামে বনিবনা হল না। তখন অগত্যা তাঁরা বসে বসে খাওয়া-দাওয়া সেরে নেন। হাতে তো খুব বেশি পয়সা থাকে না। হয়তো শুকনো রুটি খেয়েই থাকতে হয়। আর থাকে গান। গলায় সারাদিন বাউল গান, দেহতত্ত্বের গান। গান গেয়েই ক্লান্তি অপোনদন।