বিড়লা সাম্রাজ্যের শতবর্ষে ফিরে দেখা চটকল নগরী বিড়লাপুরকে

সালটা ১৯১৯। গঙ্গার এক্কেবারে পাড় ঘেঁষে গোড়াপত্তন হল কর্মে ও ধর্মে প্রথম ভারতীয় চটকলের। বিড়লাদের চটকলকে ঘিরেই ধীরে ধীরে গোড়াপত্তন হল বিড়লাপুর শহরের।

Updated By: Nov 6, 2019, 01:09 PM IST
বিড়লা সাম্রাজ্যের শতবর্ষে ফিরে দেখা চটকল নগরী বিড়লাপুরকে

অর্কময় দত্ত মজুমদার

বিড়লা সাম্রাজ্য শতবর্ষে পা দিল চলতি বছরে। কর্মসূত্রে সপ্তাহ দুয়েক আগে এই সাম্রাজ্যের প্রথম ' ইমারত ' বিড়লা চটকলে যাওয়ার ও স্বচক্ষে দেখার সুযোগ হয়েছিল। ভারতীয় শিল্প অর্থাৎ যাকে বলে ইন্ডাস্ট্রির আঁতুড়ঘর থেকে কিছু ফার্স্ট হ্যান্ড অভিজ্ঞতা রইল পাঠকদের জন্য।

শুরুটা হয়েছিল বিদেশিদের হাত ধরে। প্রথমে ওলন্দাজ, ফরাসি বণিকরা এই ব্যবসা শুরু করে। সে বহুকাল আগের কথা। পরে অবশ্য এই বিশ্বে যা কিছু লাভজনক সবকিছুর মতো এই ব্যবসাতেও আধিপত্য জমিয়ে বসে ইংরেজরা। কোন ব্যবসা নিশ্চয় আপনাদের জানতে ইচ্ছে করছে? পাটের কথা বলছি। এও একপ্রকারের সোনাল শস্য।

তবে স্বাধীনতার প্রায় তিন দশক আগেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চটকলের ব্যবসায়ে আঘাত হেনেছিলেন এক ভারতীয় ব্যবসায়ী। সালটা ১৯১৯।  অধুনা দক্ষিণ ২৪ পরগণার বজবজ পেরিয়ে, গঙ্গার এক্কেবারে পাড় ঘেঁষে গোড়াপত্তন হল কর্মে ও ধর্মে প্রথম ভারতীয় চটকলের। বিড়লা জুট মিল। প্রোপ্রাইটারের নাম ঘনশ্যামদাস বিড়লা। ভাষায় অবাঙালি হলে কী হবে, জি ডি বিড়লা মানেই বাংলার শিল্প ইতিহাসের স্বর্ণযুগের অন্যতম পথিকৃৎ! বড়লোক হওয়ার রূপক হিসেবে, বছর পাঁচেক হল, 'টাটা-অম্বানি' শব্দবন্ধ ব্যবহার হওয়া শুরু হয়েছে। তার অনেক আগে থেকেই বড়লোক মানেই বাঙালির কাছে ছিল 'টাটা-বিড়লা'! তো এহেন বিড়লাদের পুরোধাই ছিলেন জি ডি বিড়লা।

বিড়লাদের এই চটকলকে ঘিরেই ধীরে ধীরে গোড়াপত্তন হল বিড়লাপুর শহরের। অবশ্য এই গোটা শহর তৈরি হয় ঘনশ্যাম দাসের সুযোগ্য ভ্রাতুষ্পুত্র মাধব প্রসাদ বিড়লার হাত ধরে। চটকলের পাশাপাশি বিড়লাপুরের মাটিতে একাধিক কারখানা তৈরি করেন এমপি বিড়লা। সেইসঙ্গে শ্রমিকদের বসবাসের জন্য জায়গা। সবমিলিয়ে পত্তন হয় বিড়লাপুরের। প্রায় ৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এই শহর গড়ে ওঠে। ২০১১ সালের সেনসাস বলছে ২২ হাজার ৭৮ জন ব্যক্তির বসবাস এই বিড়লাপুরে। তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই চটকলের শ্রমিক।

তো জিডি সাহেব নাকি, রাজ্যের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের পরম বন্ধু ছিলেন। শিল্পপতি ও রাজনৈতিক কেউকেটাদের মধ্যে বন্ধুত্ব থাকাটাই স্বাভাবিক। চিরকাল-ই তাই হয়ে আসছে। বর্তমানেও তার উদাহরণ ভূরিভূরি। সে যাই হোক। বিধানচন্দ্র রায় ও জিডি সাহেবের এই বন্ধুত্বের গল্পগাথা আজও বিড়লা চটকলের আনাচে কানাচে কান পাতলেই শোনা যায়। আবার একই গল্প নিয়ে মতান্তরও রয়েছে।

শোনা যায়, বজবজ থেকে বিড়লাপুর পর্যন্ত রেল লাইন পাতার একটা কথা হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই তার বন্ধুর কাছে এহেন প্রস্তাব রেখেছিলেন। তবে সেই প্রস্তাব বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাধ সেধেছিলেন জিডি সাহেব নিজেই। একপক্ষের বক্তব্য, বিধান রায়ের প্রস্তাব ছিল সরকার রেল লাইন গড়ে দেবে মানুষের সুবিধার জন্য। রেল মন্ত্রক যেমন করে থাকে আর কি! কিন্তু জিডি সাহেব নাকি বলেছিলেন, বিড়লাপুর অবধি রেল লাইন পাতা হলে তা বিড়লাদের অর্থব্যয়েই হবে। নচেৎ নয়। বন্ধুর এই স্বাভিমানের কাছেই বলুন বা সরকারি নিয়মকানুনের আওতায় থাকতে গিয়েই বলুন, মুখ্যমন্ত্রী জিডি সাহেবের কথা মানতে পারেননি।

তবে আরেকপক্ষের মত হল, জিডি সাহেব নাকি পত্রপাঠ বিধান রায়ের প্রস্তাব নাকচ করেছিলেন এই বলে যে অনন্য বিড়লাপুরে ভেজাল মিশতে তিনি দেবেন না। প্রসঙ্গত বলে রাখি, আজও বিড়লাদের অফিসে, কারখানায় সমস্ত জায়গায় মাছ-মাংস-পিঁয়াজ-রসুন নিষিদ্ধ। এবার এই মনোভাবকে পাঠক কীভাবে বিচার করবেন তা পাঠকের উপর-ই ছেড়ে দিলাম।

আরও পড়ুন, ফুটবলের আকারে টিউমার! বিরল কোলন ক্যান্সার নিরাময়ে সাফল্যের নজির কলকাতায়

চটকলের মধ্যেই কর্মীদের জন্য রয়েছে গোটা একটা প্রেক্ষাগৃহ। রয়েছে পেল্লায় একখান বিলিয়ার্ডস টেবিল। আছে বারোমাসি আম গাছ, হনুমান মন্দির। রথের দিন গোটা বিড়লাপুর প্রদক্ষিণ করে যে রথ, সারা বছর সেও বিশ্রাম নেয় চটকলের ভিতরে এক কোণে। আর আছে একখান লাইট হাউজ। যার গায়ে বড় বড় করে চারটি সংখ্যায় একটা ইতিহাস লেখা আছে, ১৯১৯! বিড়লাপুরে পা রাখলেই শোনা যায় তাঁতের সেই খটাং খটাং আওয়াজ। সত্যি বলতে ইতিহাসের গন্ধ মাখা এমন শ্রুতিমধুর আওয়াজ আমি বড় কম শুনেছি। মাঝে মাঝে আবার মনে হয়, কতগুলো যন্ত্র কীরকম অনুশাসন মেনে পড়া করছে যেন!

.