ঈশ্বর কণার অস্তিত্ব মানল সার্ন

ঈশ্বর কণার অস্তিত্ব কি সত্যিই আছে? নাকি তা নেহাতই গাণিতিক মরিচিকা? বিতর্কটা চলেছিল বিগত ৫ দশক ধরে। অবশেষে আজ ইউরোপিয়ান অর্গানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ বা সার্নের গবেষকরা তাঁদের পরীক্ষারলব্ধ ফলের ভিত্তিতে মেনে নিলেন তার অস্তিত্ব।

Updated By: Jul 4, 2012, 11:08 AM IST

ঈশ্বর কণার অস্তিত্ব কি সত্যিই আছে? নাকি তা নেহাতই গাণিতিক মরিচিকা? বিতর্কটা চলেছিল বিগত ৫ দশক ধরে। অবশেষে আজ ইউরোপিয়ান অর্গানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ বা সার্নের গবেষকরা তাঁদের পরীক্ষারলব্ধ ফলের ভিত্তিতে মেনে নিলেন তার অস্তিত্ব। সার্নের ভিডিও ফুটেজেও তুলে ধরা হয়েছে `গড পার্টিকল্‌স`-এর ছবি।
পদার্থবিদ্যার যে তত্ত্ব কোনও বস্তুর ভর ব্যাখ্যা করে তা স্ট্যান্ডার্ড মডেল। আর স্ট্যান্ডার্ড মডেলের অস্তিত্ব নির্ভরশীল ঈশ্বর কণার ওপর। পদার্থবিদ্যার স্ট্যান্ডার্ড মডেল বলে, মহাবিশ্বে প্রতিটি বস্তুর ভরের প্রাথমিক ভিত্তি একধরণের অদৃশ্য কণা। কোনও বস্তুর ভর কেন অন্য বস্তুর থেকে আলাদা হয়? কোন বস্তুর ভর কতটা হবে? মহাবিশ্বে কোথা থেকে প্রতিটি বস্তু তার ভর খুঁজে পায়? স্ট্যান্ডার্ড মডেলের তত্ত্ব বলে, এই সমস্ত কিছুই নির্ভর করে ঈশ্বর কণার ওপরে। ১৯৬০ সালে ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী পিটার হিগস তত্ত্বগতভাবে এই কণার কথা বলেছিলেন। হিগসের উল্লেখিত এই কণার চরিত্র সম্পর্কে আলোকপাত করেছিলেন ভারতীয় বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। দুই বিজ্ঞানীর নামে কণাটির নাম দেওয়া হয় হিগস-বোসন। এতদিন অদৃশ্য এই কণার অস্তিত্ব ছিল শুধুমাত্র গাণিতিক বিশ্বাসে। অথচ একে ছাড়া যাবতীয় বস্তুর উপস্থিতি অসম্ভব। তাই আরেক বিজ্ঞানী এই কণার নাম রাখেন ঈশ্বর কণা।
হিগস বোসন নামক এই কণাটির ভর আনুমানিক একশো ছাব্বিশ গিগা এলেকট্রন ভোল্ট, যা প্রোটন কণার থেকে প্রায় একশো তিরিশ গুণ বেশি। প্রাথমিক পরীক্ষার ফল অনুযায়ী, একশো ভাগ না হলেও, বিজ্ঞানীরা প্রায় নিশ্চিত তারা হিগস বোসনের নাগাল পেয়ে গিয়েছেন। তবে ‌অ্যালাস এবং সিমএস নামে দুটি আলাদা যন্ত্রের পরীক্ষার ফলাফল আরও খুঁটিয়ে দেখে এবং তার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে তবেই তাঁরা একশো শতাংশ নিশ্চিত হতে পারবেন।

গত ৫ দশকে বহুবার ঈশ্বর কণার অস্তিত্ব সন্ধানের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। ১৮ মাস আগে, ইউরোপিয়ান অর্গানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ বা সার্ন শুরু করে তাদের বিজ্ঞানের মহাযজ্ঞ। ফ্রান্স-সুইত্জারল্যান্ড সীমান্তে মাটির একশো মিটার নীচে ষোলো মাইল লম্বা সুড়ঙ্গ খুঁড়ে বসানো হয় লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার। প্রাথমিকভাবে বিগ ব্যাং বা মহাজাগতিক বিস্ফোরণের পরমুহূর্তের পরিস্থিতি সৃষ্টি করাই ছিল বিজ্ঞানীদের উদ্দেশ্য। যার থেকে জানা যেতে পারত ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির রহস্য। সেই পরীক্ষায় লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে দুটি বিপরীতমুখী প্রোটনের সংঘর্ষ ঘটান বিজ্ঞানীরা। গত ১৮ মাস ধরে চলে, সবচেয়ে ব্যয়বহুল এই পরীক্ষা।
গত ডিসেম্বরে, একটি দুর্বল সিগন্যাল পেয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। দুই প্রোটনের সংঘর্ষে সৃষ্ট অপরিচিত এক কণা তার অস্তিত্বের জানান দিয়ে মিলিয়ে যায়। প্রোটনোর সংঘর্ষের পর সৃষ্ট কণার স্থায়িত্ব ছিল এক সেকেন্ডের একলক্ষ ভাগের একভাগ সময়। বিজ্ঞানীরা তখনই একে ঈশ্বর কণা বলতে চাননি। আরও নিশ্চিত হতে পরীক্ষা চালিয়ে যান তাঁরা। অবশেষে বুধবার জেনিভায় সার্নের সদর দফতর থেকে তাঁরা পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করেন। ভিডিও চিত্র প্রকাশ করে ঘোষিত হয় ঈশ্বর কণার অস্তিত্বের কথা। ঈশ্বর কণার অস্তিত্ব প্রমাণ হওয়ায় এবার পদার্থবিদ্যার স্ট্যান্ডার্ড মডেল বৈজ্ঞানিক প্রামাণিকতা পেল। অন্যভাবে বলতে গেলে, কণা পদার্থবিদ্যায় `ঈশ্বরের` অস্তিত্বের প্রমাণ মিলল। যদিও তারপরেও, স্ট্যান্ডার্ড মডেল ব্রহ্মাণ্ড পরিচালনায় শেষ কথা বলবে না। কারণ, এই মডেল মহাকর্ষ বল বা কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করতে পারে না। লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে অ্যাটলাস এবং সিএমসি, দুটি অংশে হিগস বোসনের খোঁজে পরীক্ষা চালানো হয়েছিল। দুই দল বিজ্ঞানীই পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে প্রায় নিশ্চিত হলেও, প্রশ্ন একটা থেকেই যাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের সামনে এখন তিনটি সম্ভাবনা। নতুন কণাটিই হিগস বোসন। অথবা নতুন কণাটি হিগস বসন হলেও, স্ট্যান্ডার্ড মডেলে বর্ণিত কণার সঙ্গে তার ফারাক রয়েছে। নয়তো এটি সম্পূর্ণ একটি নতুন পারমাণবিক কণা। পরীক্ষার ফল যাই হোক, সার্নের আবিস্কার যে কণাপদার্থবিদ্যায় নতুন দিশা এনে দেবে, তা নিয়ে সংশয় নেই বিজ্ঞানী মহলে। কলকাতার সাহা ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স সহ বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা যৌথভাবে এই প্রকল্পে কাজ করেছেন। একবিংশ শতাব্দীর পদার্থবিদ্যার ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে এই পরীক্ষা চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

.