পুরুষের গর্ভে নারীর জন্ম

Updated By: Sep 27, 2016, 08:14 PM IST
পুরুষের গর্ভে নারীর জন্ম

সৌরভ পাল 

 

'তুমি আসবে ব'লে ঐখানে রেখেছি ধুলোর আসন
ঐখানে রাখা আছে পারিজাত রেনু মাখা জলের কলস
ঐপথ কণ্টকবিহীন ফুল সাজিয়েছি, পদভার রাখবে বলে তুমি
স্নানের নিমিত্ত ঐ বহমান পুণ্যশীলা অলস তটিনী
অনুষ্টুপ ছন্দ থেকে সঙ্গীতের তালটুকু ভরা আছে কণ্ঠ-হৃদয়ে 
তুমি শুধু আসবে ব'লে আলোর প্রদীপখানি নিভেছে শিশিরে...
এখন স্বপ্নের মতো নক্ষত্রেরা ছড়িয়েছে আলো...'

(এই সৃষ্টি কৌশিক বাজরীর। শিল্পকর্মের নাম- 'নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু') 

না কোনও কাব্য করতে কলম ধরিনি। সমাজের তথাকথিত ভাবধারার কিছু উল্টোকথা বলতেই সাদাপাতা কালো করার সাধ জেগেছে। কথা বলব কুমারটুলি নিয়ে। কথা বলব ঈশ্বরের জন্মের বাস্তব নিয়ে, কথা বলব কুমারটুলির সেই পুরুষদের নিয়ে যারা গর্ভধারণ করেন। প্রতিটি পুরুষ এখানে প্রতিনিয়ত জন্ম দিচ্ছেন নারীর। ১০ মাসের ১০ দিনের গর্ভ যন্ত্রণার পর সৃষ্টি হচ্ছে এক একটা শিল্প ভাস্কর্য। সন্তানের জন্ম হচ্ছে ক্লান্তিহীন নিরবধি পরিশ্রমের পর। শুধু নারীই বা বলছি কেন? পুরুষও তো জন্ম নিচ্ছেন এখানেই। নর-নারী, রমণ-রমণী, দেব-দেবী, ঈশ্বর-ঈশ্বরী সবাই একে একে জন্ম নিচ্ছেন কুমারটুলির গর্ভে। পুতুলের জন্ম দেয়না কুমারটুলি! জন্ম দেয় সন্তানের। জন্ম দেয় দেবী অম্বিকার। বাল কৃষ্ণ থেকে কার্তিক, পেট মোটা গণেশ থেকে স্লিম শিব, সবার জন্ম এখানেই। জন্মদাতা তাঁর হাতের নৈপুণ্যতায় সৃষ্টি করেন এনাদের। 

কথা প্রসঙ্গে একটু পুরাণের পাতায় ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। কীভাবে আবির্ভূতা হলেন দেবী দুর্গা? মনে আছে? একটু ছুঁয়ে যাচ্ছি। মহিষী পুত্র অসুরের মৃত্যু কামনা করে দেবরাজ ইন্দ্র এবং স্বর্গের ব্রিগেডিয়াররা দরবার করেছিলেন তিন দেবের কাছে। আর সেখানেই ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের অগ্নিতেজে সৃষ্টি হলেন মহামায়া। পুরুষেই সৃষ্টি হয়েছিলেন নারী। অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই! কী অদ্ভুদ পৌরাণিক কাণ্ড, ভাবলেই অবাক লাগে! ঋষি কাত্যায়নী অভিশাপ দিলেন 'পুরুষ' অসুরকে। যে নারী রূপে মহিষাসুর ছলনা করেছিলেন সেই নারীর হাতেই মৃত্যু হবে ত্রিকালজয়ী পরাক্রমী অসুরের। উল্টে পাল্টে যেভাবেই দেখুন, ভাবুন পুরুষেই নারীর জন্ম হয়েছে। অন্তত দেবী দুর্গার ক্ষেত্রেও তো তাই। মহিষাসুরও এত রূপ থাকতে নারী রূপেই ছলনা করলেন। অগত্যা নারীকেই সৃষ্টি করতে হলে দেবতাদের। এটাই বিধান আর এটাই নিদান। মহাময়া কখনও পুজো নিতেও অস্বীকার করেন না, পুরোহিত পুরুষ বলে। এটাই ফ্যাক্ট।

এবার সরাসরি কুমারটুলির নারী সৃষ্টির কথায় আসি। কাঠামো তৈরি। কে করেন? পুরুষ। খর কে বাঁধেন? পুরুষ। মাটির প্রলেপ কে দেন? পুরুষ। মাটির অবয়বে রং কে করেন? পুরুষ। চোখ কে আঁকেন? পুরুষ। শাড়ি কে পড়ান? পুরুষ। অলংকারে সুসজ্জিত কে করেন? পুরুষ। পুজো কে করেন? পুরুষ। দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠার সময় তো নারীর প্রবেশেই নিষেধাজ্ঞা। আর বিসর্জন? সেও পুরুষের হাতেই। ক্ষমা করবেন। আমি পুরুষবাদী নই। অবশ্য পুরুষবাদী বলে কিছুর অস্তিত্ব আছে কিনা সেনিয়েও আমার সংশয় আছে। ফ্যামিনিজিমেও আপত্তি নেই। তবে যে কথাটা বলতে এতোগুলো কথা বলা, নারী সৃষ্টিতে পুরুষের স্বরূপ অনস্বীকার্য। নারীতে যেমন নারী আছে, তেমন আছে পুরুষও। পুরুষ ও প্রকৃতির অমোঘ মেল বন্ধন এখানেই। কুমারটুলি তাঁর জীবন্ত উদাহরণ।

মা কিংবা পিতা যখন শেষ সজ্জায়। কাঠের বাসরে নিথর দেহ। সম্পর্ক তখন যাই থাকুক, 'ডেড বডি'তে মুখাগ্নিও করেন একজন পুরুষ। হ্যাঁ, একথা মানতেই হবে, এই সমস্ত ট্যাবু ভাঙছে। সমাজের আধুনিক হওয়া, নারীদের অর্ধেক আকাশের লড়াই, সমানের অধিকার, সমস্ত বঞ্চনার ইতিহাস মুছে দিয়ে কাঁধে কাঁধই হয়েছে আসল পরিচিতি। কুমারটুলিতেও তাই। কাঞ্চি, মালা, চায়না এই তিন পালই এখনও পর্যন্ত মহিলা শিল্পী। নারীশক্তি তৈরি করছেন তিন নারী। এখানেই আবার আলাদা হওয়ার একটা ছোট্ট মারপ্যাঁচ। শিল্পী শিল্পীই হয়, নারী অথবা পুরুষ বলে আলাদা কিছু হয় না।           
    

একটা কালো পাথরও স্রেফ বিশ্বাসের জোরেই ঈশ্বর হয়ে ওঠে। কালো শালগ্রাম শিলা হন নারায়ণ। ঐ কালো পাথরই কখনও কৃষ্ণ আবার কখনও ঐ একটা পাথর টুকরোই পূজিত হন শিবের অবয়ব রূপে। এক একটা মাটির ডেলাও প্রাণ প্রতিষ্ঠায় দেবত্ব অর্জন করে। আর এই দেবত্ব এনে দেন পুরুষই। দেবী দেবীর মত হবেন না, হবেন নিজের মেয়ের মতই। তাঁর মুখ, তাঁর গড়ন, তাঁর গঠন সবটাই হবে জীবনের আঙ্গিকে। 'লার্জার দেন লাইফ' এই কনসেপ্ট ভেঙে ঘরের মেয়েকেই পুজো করা হবে মা দূর্গা রূপে-এই ভাবনাটা প্রথম এনেছিল কুমারটুলিই।

লেখা বেশি এগোবো না। তবে একটা কথা না বললেই নয়। লেখায় পুরুষের গর্ভে নারীর জন্ম দেওয়া যায়। কারণ এটা ভাবনা। তবে এটাও ঠিক, বিজ্ঞানের অবদানে পুরুষ পিতা হয়েছেন গর্ভে ভ্রুনের জন্ম দিয়েই।            

 

 

.