তাঁদের যাত্রা 'মঙ্গল' হোক…

Updated By: Sep 27, 2016, 07:32 PM IST
তাঁদের যাত্রা 'মঙ্গল' হোক…

বৃষ্টি মিত্র 

সব কিছু জেনে শুনে মঙ্গলে পা রেখেছিলেন তাঁরা। পৃথিবী ছোট ক্ষতি নেই, মহাকাশ যে বড়। যখন পৃথিবীর বুকে মানব সভ্যতার পরিসংখ্যান হাজার কোটি ছুঁয়ে উথলে উঠবে, ভাঁড়ার ঘর যখন সম্পদ শূন্য হবে, মানুষ ব্যতীত জীবকুল ও উদ্ভিদকুল বিরল থেকে বিরলতম-তে পৌঁছবে, হয়ত সেদিন বিকল্প গ্রহের সন্ধান করতে হবে আমাদের। কারণ, আগামী প্রজন্মকে জায়গা করে দেওয়ার মতো কিছুই থাকবে না। তাই ভবিষ্যতে পৃথিবীর মঙ্গলায়ন করার ভাবনায় তাঁদের আজ তাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়েছে মঙ্গলের দিকে।

ছয়জনের সবাই যে প্রকৃত বিজ্ঞানী তা নয়। চারজন আমেরিকানের মধ্যে পাইলট, আর্কিটেক্ট, সাংবাদিক ও মৃত্তিকাবি়জ্ঞানী ছিলেন। বাকি দুইজনের একজন ফরাসি অ্যাস্ট্রো বায়োলজিস্ট ও অন্যজন জার্মান পদার্থ বিজ্ঞানী। এই গ্রুপের তিনজন ছিলেন পুরুষ ও বাকিরা মহিলা। তাঁরা যে আম-সাধারণের থেকে অনেক আলাদা। তাঁরা জানেন, নিজের গ্রহ থেকে মঙ্গল অনেক বেশী শীতল। সেখানকার স্বাভাবিক তাপমাত্রা -৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। শীতকালে মঙ্গলের দুই মেরুতে তাপমাত্রা নেমে দাঁড়ায় -১২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। মানুষ থাকার পক্ষে এই পরিবেশ একেবারে প্রতিকূল, তাঁদের অজানা ছিল না। 

মঙ্গলের বায়ুস্তর পাতলা। এখানকার মাধ্যাকর্ষণ শক্তি পৃথিবীর থেকে প্রায় ৩৮ শতাংশ কম। এমন কী আর্মস্ট্রং লিমিটের নীচে বায়ুর চাপ থাকায় প্রেসার স্যুট না পরেই এখানকার রুক্ষ্ম, শুষ্ক পরিবেশে বিনদাস ঘোরা ফেরা করা যেতে পারে। তবে, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি পৃথিবীর তুলনায় প্রায় ৪৩ শতাংশ কমের কারণে পেশীর শক্তি ক্ষয় ও বোন ডিমিনারেলাইজেশন হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে প্রবল। তাছাড়া মঙ্গলে অক্সিজেন নেই বললেই চলে। এখানকার বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড ম-ম করছে। 

ধূ ধূ প্রান্তর। পাথুরে মাটি।রসাল, মায়া, মমতা, প্রেমে ভরপুর নীল গ্রহ থেকে নীরস, শুষ্ক, ভাবলেশহীন লাল গ্রহে মাসাধিকাল থাকা যে কতটা কঠিন, এই মহাকাশচারীরাই জানেন। স্বামী, সন্তান, স্ত্রী, পরিবার, পরিজন, নিজের শহর, দেশ সব কিছু ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে তাঁদের। ১৫০০ স্কোয়ার ফুট জায়গা জুড়ে তৈরি একটি সাদা ডোমের ভিতর ছয়টি ভিন গ্রহের প্রাণী দিনের পর দিন গবেষণা করে চলেছেন। প্রতিকূল পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার অক্লান্ত প্রচেষ্টা করে চলেছেন। একদিন নয়, দুই দিন নয়, মাসের পর মাস ডোমের ছোট্ট গোল জানালা দিয়ে তাঁরা  তাকিয়ে দেখতেন পাহাড়ে কোলে সূর্যের নিস্তব্ধ যাতায়াত।যদিও বেশিরভাগ দিনই চারিদিক থাকত ধুলোয় ঢেকে। ধুলো ঝড় শুরু হলে থামার বারণ ছিল না। কয়েক মাস পুরো বায়ুমণ্ডল ধুলোর চাদরে মোড়া থাকত। তখন বাইরে বেরনোর কোনও উপায় ছিল না। ডোমের ভিতর গান শুনে, পরিবার পরিজনের স্মৃতি রমন্থন করে দিন গুজরান করতে হত মহাকাশচারীদের। প্রতিদিনের খাবার বলতে ছিল পনীর গুঁড়ো আর ট্র্যাঙ্ক ভর্তি টুনা মাছ। খেতে খেতে জিহ্বে শ্যাওলা পড়ে গেলেও পিৎজা খাওয়ার কোনও উপায় ছিল না। এখান থেকে তাঁদের শহর যে অনেক আলোকবর্ষ দূরে।

এই পর্যন্ত গল্প ঠিক চলছিল। ছন্দপতন ঘটল ৩৬৫ দিন পর। এক বছর ‘মঙ্গলে’ কাটানোর পর ছয মহকাশচারী ফিরে আসেন পৃথিবীতে। কাস এই লাইনটি যদি সত্যি হত! কিন্তু বাস্তব তা ছিল না। ওই ছয় মহাকাশচারীর চোখে এ সব শব্দ খরচ করে মঙ্গলের আবহ আঁকার শুধুমাত্র চেষ্টা করলাম। কারণ পৃথিবীর বুকে শ্বাস নিয়ে মঙ্গলের গবেষণা করা আকাশ-পাতাল তফাত্। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের মৌনা লোয়ার একটি আগ্নেয়গিরিতে আস্তানা গড়েছিলনে তাঁরা। লাভা পরিপূর্ণ রুক্ষ্ম, শুষ্ক পরিবেশ দেখতে হয়তো অনেকটা মঙ্গলের মতো। এখানে মঙ্গলের কৃত্রিম পরিবেশ তৈরি করে নাসা। লক্ষ্য ছিল ২০৩০-এ লাল গ্রহে পাড়ি দেওয়ার আগে নিজদেরকে প্রস্তুত করে নেওয়া। মঙ্গলে থাকতে গেলে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকা দরকার। মস্তিস্কের উপর কঠোর সংযম না থাকলে মঙ্গলের পরিবেশকে মানিয়ে নেওয়া খুব কঠিন। এরই মহড়া চলছিল ওই হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে। 

কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলায় একটানা ৩৬৫ দিন হাওয়াইয়ে কাটিয়েও কি মহাকাশচারীরা মঙ্গলে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত হলেন? মঙ্গলে উপনগরী তৈরির করতে তাঁদেরকে পাঠালে কতখানি সফল হবেন? রাশিয়া এর আগে এমনই একটি প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। ২০৩০ সালে মঙ্গলে পাড়ি দিয়ে এক-দেড় বছর গবেষণা করার পরিকল্পনা রয়েছে নাসার। তবে, আজ এ কথা অলীক মনে হলেও, কাল বাস্তব হবে না কে বলতে পারে? ১৯৩২ সালে সামান্য একটি টেলিস্কোপে প্লুটোর সন্ধান পেয়েছিলাম। আজ আধুনিক প্রযুক্তির দৌলতে সৌরজগতের শেষ প্রান্তে পৌঁছতে পেরেছি। প্লূটোকে সচক্ষে দেখেও এসেছি আমরা। তাই, প্রস্তুতি জারি থাক। কিউরিসিটির মাধ্যমে চলুক গভীর গবেষণা। এমন দিন হয়ত আসবে, কয়েক দিনের ছুটি কাটাতে তল্পিতল্পা নিয়ে মঙ্গল বিঁভুইয়ে ঘুরতে যাচ্ছি। কেউ আবার হানিমুন সারতে প্যারিস বা সুইজারল্যান্ড নয়, সোজা মঙ্গলে যাওয়ার জন্য টিকিট বুক করছেন। এমন ভোরের স্বপ্ন সত্যি হতে হয়ত আর বেশি দিন বাকি নেই। সবুর অলরেডি করে ফেলেছি। এবার আমরা তাকিয়ে আছি মেওয়া ফলের দিকে।

.