নিলাম বনাম বৃহত্তর মঙ্গল

নিলাম বনাম বৃহত্তর মঙ্গল বিতর্কে অত্যন্ত সুবিবেচনাপ্রসূত রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। আমাদের দেশে রাজনীতি পরিচালিত হয় আবেগ, অজ্ঞতা এবং দুষ্টবুদ্ধির ত্রিফলা দ্বারা। প্রায়শই এই ত্রয়ীর মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলে কে অন্যদের পিছনে ফেলে রাজনীতির উপর তার দখলদারি আরও বাড়াতে পারে, তার।

Updated By: Sep 28, 2012, 08:31 PM IST

নিলাম বনাম বৃহত্তর মঙ্গল বিতর্কে অত্যন্ত সুবিবেচনাপ্রসূত রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। আমাদের দেশে রাজনীতি পরিচালিত হয় আবেগ, অজ্ঞতা এবং দুষ্টবুদ্ধির ত্রিফলা দ্বারা। প্রায়শই এই ত্রয়ীর মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলে কে অন্যদের পিছনে ফেলে রাজনীতির উপর তার দখলদারি আরও বাড়াতে পারে, তার। এমতাবস্থায় আদালতের চাবুক রাজনীতির দাপটে রাশ টেনে শুভ বুদ্ধির বিকাশের পক্ষে মোক্ষম দাওয়াই। সুপ্রিম কোর্ট সেই দাওয়াই দিয়েছে।

২জি স্পেক্ট্রাম মামলায় ১২২টি লাইসেন্স বাতিল করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। এর পর শীর্ষ আদালতের কাছে প্রেরিত হয় রাষ্ট্রপতির অনুজ্ঞা। জানতে চাওয়া হয়, প্রাকৃতিক সম্পদ বণ্টনে সরকারের নীতি কীসের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে? সেই প্রেসিডেনশিয়াল রেফারেন্সের জবাবেই সুপ্রিম কোর্ট ২৭ সেপ্টেম্বর বলেছে, লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে বণ্টন প্রক্রিয়ার মধ্যে কারচুপি ছিল বলে, সরকারের নীতি ভুল ছিল বলে নয়। প্রাকৃতিক সম্পদ বণ্টনের মতো অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে নীতি প্রণয়ণটা সরকারেই কাজ, আদালতের নয় - এটাও স্পষ্ট বলেছে সুপ্রিম কোর্ট। যে সম্পদ সীমিত কিন্তু তার দাবিদার অনেক, তার বণ্টনের ন্যায্য পদ্ধতি কী হওয়া উচিত? নিলাম করলে বেশি টাকা ঘরে আসে নিশ্চিত। কিন্তু সেটা কি সব পরিস্থিতিতে ন্যায্য?

মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির আসন নিলামে বিক্রি করলে তাকে আমরা ঘোরতর দুর্নীতি বলব। এমনকি লটারি করে বণ্টন করলেও অন্যায় বলব। আমরা বলব, মেধার ভিত্তিতে হওয়া উচিত। হয়তো একটু আপস করা য়েতে পারে অনগ্রসরদের সুযোগ দেওয়ার জন্য।

মধ্যবিত্তদের জন্য সরকারি ফ্ল্যাট নিলামে বিক্রি করলেও আমরা অন্যায় বলব। কারণ, খরচের টাকা তুলে কিছু লাভ করাকে আমরা বৈধ মনে করি। যত বেশি সম্ভব লাভ করার বাসনা সরকারের থাকা উচিত নয়। যেহেতু চাহিদার তুলনায় জোগান কম, তাই এ ক্ষেত্রে লটারি প্রথা আমাদের মতে ন্যায্য।

বিশিষ্ট শিল্পীর আঁকা চিত্র নিলামে বিক্রি করাতে কারও আপত্তি নেই।

জিনিসটা অত্যাবশ্যক নয়, প্রাকৃতিক সম্পদও নয়, মালিক স্বভাবতই সর্বোচ্চ দামে বিক্রি করতে চাইবেন। কয়লা খনির ইজারা নিলামে বণ্টন করে সরকারের ঘরে বেশি টাকা আসা নিশ্চয়ই স্বাগত। সরকারের টাকা তো সাধারণ মানুষেরই টাকা। কিন্তু অন্য সব বিবেচনা মুলতুবি রেখে শুধু টাকার অঙ্কে নিলামের সর্বোচ্চ হাঁকে সাড়া দেওয়া কি সরকারের উচিত? কয়লার অন্যতম ব্যবহার বিদ্যুত্ উত্পাদনে, যার সিংহভাগই সরকারের নিয়ন্ত্রণে, এবং যে বিদ্যুতের দাম এমনকি বেসরকারি উত্পাদকও ইচ্ছা মতো বাড়াতে পারেন না। যদি কয়লা খনির ইজারা নিয়ে কেউ পরিকল্পনা করেন বিশ বছর বাদে বিদ্যুত্কেন্দ্র বানাবেন? যদি বেশি লাভের জন্য কেউ পুরো কয়লাটা বিদেশে রফতানি করে দেন? নিলামে ইজারা নেওয়ার পর যদি কেউ দেখেন, বিদ্যুত্ উত্পাদনের চেয়েও লাভজনক অন্য ব্যবসা? তা হলে বিদ্যুত্ উতপাদন বন্ধ থাকবে? দেশের অর্থনীতি স্তব্ধ হয়ে যাবে?

সকলেই বলবেন, না। সরকার রয়েছে সর্বজনের বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য। নিলাম হেঁকে শুধু টাকা তোলার জন্য নয়। বেশি আয় এবং সর্বজনের মঙ্গলের ভারসাম্য রক্ষাই সরকারের কাজ। এই সরল কথাটা আবেগ, অজ্ঞতা এবং দুষ্টবুদ্ধি চালিত আমাদের রাজনীতিকরা বোঝেন না, অথবা বুঝেও স্বীকার করেন না - বিশেষ করে তাঁরা যখন সরকারের বাইরে থাকেন। তাঁদের মাথায় গজাল মেরে এটা বোঝানোর কাজটা করল সুপ্রিম কোর্ট।

সুদীপ্ত সেনগুপ্ত
(এডিটোরিয়াল কনসালট্যান্ট)

Tags:
.