প্রপাতের পথে

সালওয়া জুড়ুমের উত্‍স সন্ধানে গিয়েছি বিজাপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম কারকেলিতে। সময়টা নভেম্বরের মাঝামাঝি। ছত্তিসগড় জুড়ে ভোটের হাওয়া। দু'দিন আগেই সুকমার কাছে ভোটকর্মীদের হেলিকপ্টার গুলি করে নামিয়েছে মাওবাদীরা। গ্রামবাসীদের সতর্কবাণী সত্ত্বেও কাজ মিটিয়ে জগদলপুরের পথ ধরতে না ধরতেই সুয্যিমামা ডুব দিলেন বস্তারের পাহাড় আর জঙ্গলের আড়ালে। প্রায় একশো ষাট-সত্তর কিলোমিটার পথ যেতে হবে। একে বিপদসঙ্কুল, তার উপর কোনও কোনও জায়গায় রাস্তা বলে প্রায় কিছুই নেই। মাওবাদী হানার ছাপ বহন করছে বিধ্বস্ত কালভার্ট।

Updated By: Oct 6, 2012, 10:22 PM IST

সালওয়া জুড়ুমের উত্‍স সন্ধানে গিয়েছি বিজাপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম কারকেলিতে। সময়টা নভেম্বরের মাঝামাঝি। ছত্তিসগড় জুড়ে ভোটের হাওয়া। দু'দিন আগেই সুকমার কাছে ভোটকর্মীদের হেলিকপ্টার গুলি করে নামিয়েছে মাওবাদীরা। গ্রামবাসীদের সতর্কবাণী সত্ত্বেও কাজ মিটিয়ে জগদলপুরের পথ ধরতে না ধরতেই সুয্যিমামা ডুব দিলেন বস্তারের পাহাড় আর জঙ্গলের আড়ালে। প্রায় ১৬০-১৭০ কিলোমিটার পথ যেতে হবে। একে বিপদসঙ্কুল, তার উপর কোনও কোনও জায়গায় রাস্তা বলে প্রায় কিছুই নেই। মাওবাদী হানার ছাপ বহন করছে বিধ্বস্ত কালভার্ট। আমার সঙ্গী ক্যামেরাম্যান কানাই আর স্থানীয় সাংবাদিক নরেশ মিশ্র। নরেশের সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয়। প্রথম পরিচয় বস্তারের সঙ্গেও। ড্রাইভারের পাশের সিটে ক্লান্ত শরীর ছেড়ে দিয়ে জটায়ুসুলভ হিন্দিতে বাতচিত্‍ চালিয়ে যাচ্ছি নরেশের সঙ্গে। হঠাত্‍ই নরেশ জানাল জগদলপুর ফেরার আরও একটা পথ আছে। অবুঝমারের জঙ্গল ঘেঁষে চিত্রকোট ফল্স ছুঁয়ে। তবে বিকেল পাঁচটার পর সে পথে কাকপক্ষীও হাঁটে না। কারণ লাগোয়া অবুঝমারের জঙ্গল মাওবাদীদের হেডকোয়ার্টার্স। চিত্রকোট ফল্স! ভারতের নায়াগ্রা! মুহূর্তে শরীরজুড়ে অ্যাড্রিনালিনের বেয়াড়া দাপাদাপি। নরেশকে বললাম, ওই পথেই যাব। কাজ তো শেষ। এখন একটু বেপথু হতে বাধা কই। সুদূর কলকাতা থেকে প্রথম বার বস্তারে আসা অর্বাচীন সাংবাদিকের আবদারে স্থিতধী, বিচক্ষণ নরেশ আকাশ থেকে পড়ে আর কী! অতএব আমাদের অঘোষিত বা স্বঘোষিত লোকাল গার্ডিয়ান হিসাবে ওই পথের যাবতীয় ভয়াবহতার কথা বিস্তারে ব্যাখ্যা করতে থাকল নরেশ। ফল হল উল্টো। ওই রহস্যময় পথ চুম্বকে টানতে লাগল আমায়। অগত্যা গাড়ি ঘুরল সে পথেই।

চারদিকে নিকষ অন্ধকার। আকাশের তারারা হঠাত্‍ যেন সযত্নে রূপটান করেছে। শুকনো পাতা আর কাঁকুড়ে মাটিতে গাড়ির চাকার শব্দ, পাহাড়ি ঝিঁঝিঁর একঘেয়ে ডাক। চড়াই উত্‍রাই ভেঙে, পাকদণ্ডী বেয়ে এগিয়ে চলেছে গাড়ি। মুখে ঝাপটা দিতে থাকা হিমেল হাওয়ায় বন্য আঘ্রান। কতক্ষণ এ ভাবে চলেছি, মনে নেই। হঠাত্‍ই কানে এল সেই শব্দ। মৃদু অথচ গভীর। দূরে একটা সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্প। নীরবতা ভাঙল নরেশের আক্ষেপে। চিত্রকোট ফল্‍স-এর ফ্লাড লাইট বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কব্জির দিকে তাকিয়ে দেখি ঘড়ির কাঁটা এগারোটার ঘরে। গাড়ি থেকে নেমে অন্ধকারেই পা বাড়ালাম। প্রবল গর্জনে তখন কান পাতা দায়। অন্ধকারে চোখ ঠিক করে ঠাহর করতে পারছে না কিন্তু হৃদয়, মস্তিষ্ক যেন আন্দাজ পাচ্ছে সেই বিশালতার। ভূতে পাওয়ার মতো এগিয়ে যাচ্ছিলাম। নিরস্ত করল নরেশ। কিনারা সামনেই। চোখেমুখে তিরের মতো বিঁধছে জলকণা। ঠিক এমন সময় আচমকা উল্টো দিকের আকাশে উঁকি দিল পূর্ণিমার দুয়েকদিন পরের ঈষত্‍ লালচে, বিষণ্ণ চাঁদ। আর সেই মায়াবী আলোয় আমার চোখের সামনে উন্মোচিত হল এক ভয়ঙ্কর সুন্দর। হাজার হাজার সাদা ঘোড়া যেন কেশর উড়িয়ে লাফিয়ে পড়ছে প্রবল তেজে। ঘোর ভাঙাল সেই নরেশ। মন্ত্রমুগ্ধের মতো উঠে বসলাম গাড়িতে। মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম নিভে যাওয়া কৃত্রিম আলোকপ্রপাতের সময়ানুবর্তিতাকে।

এরপর ইন্দ্রাবতী দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। দু'হাজার দশের এপ্রিল। দান্তেওয়াড়ায় মাওবাদী হানার শিকার ৭৬ জন জওয়ান। ক্যামেরম্যান শুভ্রকে নিয়ে পৌঁছলাম গ্রাউন্ড জিরোয়। প্রথম কয়েক দিনের তুমুল ব্যস্ততা আর ঝুঁকির পর এ বার আমাদের গন্তব্য লোহন্ডিগুড়া। এখানেই টাটাদের প্রস্তাবিত প্রকল্প ঘিরে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। একটু এগোতেই মাইলফলক জানান দিল চিত্রকোট এ পথেই। আমাদের গন্তব্য ছাড়িয়ে মাত্র মাইল চারেক। সুতরাং কাজ মিটতেই ফিরতি পথ না ধরে সোজা চিত্রকোট সন্দর্শনে। আর পৌঁছতেই বুঝলাম, কী বোকামিটাই না করেছি। মাথার উপর চৈত্রের গনগনে সূর্য। আর চিত্রকোটের রিক্ত ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ইন্দ্রাবতীর ক্ষীণকায় ধারা। কোথায় সেই প্রবল প্রতাপ? কোথায় সেই সিংহগর্জন? শুকনো মুখে ফিরে এলাম গাড়িতে।

এরপর বেশ কয়েকবার বস্তার গেলেও চিত্রকোটের পথে আর যাওয়া হয়নি। চিত্রকোট টানেওনি সেই ভাবে। নরেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব গাঢ় হয়েছে। কখনও চিত্রকোট গেলে নরেশ আমাকে ফোন করে মনে করায় আমার সেই প্রথমবারের পাগলামি। আরেক বন্ধু, বস্তারের এক বনকর্তা বহুবার সপরিবারে আমন্ত্রণ জানিয়েছে ঘোর বর্ষায় চিত্রকোটে যাওয়ার। কিন্তু খরগ্রীষ্মের সেই মোহভঙ্গের পর আর দেখা হয়নি চিত্রকোটের সঙ্গে।

এমন সময় আবার বস্তারযাত্রা। এ বার সময়টা সেপ্টেম্বর। বস্তারজুড়ে প্রবল বৃষ্টি। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই প্রথম দু'দিন কাটল ফেরার আদিবাসী শিক্ষিকা সোনি সোড়ির খোঁজে। পরদিন ভোর হতে না হতেই বেরোলাম হোটেল থেকে। বৃষ্টিটা ধরেছে মাঝরাত থেকে। সোনি সোড়ির ডেরায় পৌঁছে ইন্টারভিউ হয়ে যাওয়ায় মনটাও বেশ চাপমুক্ত। জগদলপুর শহর থেকে বেরিয়েই বুঝলাম, আবার সেই একই পথে চলেছি। অনেক দিন পর আবার অনুভব করলাম সেই টানটা। বড় অমোঘ সেই টান। চিত্রকোটের কাছে পৌঁছতে না পৌঁছতেই প্রবল গর্জন জানান দিল, শেষ বার দেখা ভীরু, কৃশ জলরাশি এখন প্রবল পরাক্রমশালী, যৌবনমদমত্ত এক জলপ্রপাত। সিংহশৌর্যে আছড়ে পড়ছে নীচে। সেই অনির্বচনীয় রূপ প্রত্যক্ষ করার জন্য দুটো চোখ যেন যথেষ্ট নয়। সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে শুধু অনুভব করা যায় ওই বিশালতাকে। দেখতে দেখতেই কখন যেন ঘোর লাগে। অবশ হয়ে আসে শরীর। সফেন জলরাশির দৃপ্ত অহং গ্রাস করে সমস্ত সত্ত্বাকে। পাশেই সঙ্গী আকবর দা-ও চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে।

কর্তব্যের তাগিদে মোহজাল ছিঁড়ে নিজেকে নামিয়ে আনতে হল বাস্তবে। যেতে হবে অনেক দূর। কুটরু। পা বাড়ালাম গাড়ির দিকে। চিত্রকোট ছেয়ে রইল আনখশির। কাব্যে ঝরনারা নারী হয়ে আসে, অথবা নারীরা ঝরনা হয়ে। কিন্তু হেমন্তের আবছায় চাঁদনি রাত বা বর্ষণ শেষের ভোর, চিত্রকোট আমায় দেখা দিয়েছিল এক উদ্দাম প্রেমিকের রূপে।

Tags:
.