সেলাম, স্যালুট এবং সাষ্টাঙ্গ প্রণাম
পাঠকেরা চোখ বুজুন। ভাবুন, আপনার বাড়িতে ঠিকে কাজ করেন যিনি, তাঁকে হঠাত্ দেখলেন, মঞ্চে সারাজীবনের অবদানের জন্য পাচ্ছেন আস্ত একটা ট্রোফি, চেক আর সম্মানপত্র। দর্শকাসন থেকে শর্বরী দত্ত, মমতা শঙ্কর, গার্গী রায়চৌধুরী, দোলন রায়, অনুপম রায় উঠে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন! হাততালির আওয়াজে কানের পরদা ফেটে যাচ্ছে।
ডেঙ্গি এসেছে, বঙ্গ ফেঁসেছে। তখনও পেটের ভেতর ভাইরাসের গিজগিজানি টের পাচ্ছি। বাসে উঠতে গেলে মাথাটা বোঁ করে ঘুরে যাচ্ছে। নীলদার নির্দেশ, অনন্য সম্মানের আগে উঠে দাঁড়াতেই হবে, যেভাবেই হোক। গুচ্ছের কাজ ফেলে রেখে মাঝপথেই আমি বিছানা নিয়েছিলাম। এন এস ওয়ান পজিটিভ। ম্যাক ইলাইজা টেস্ট-ও। সাক্ষাত্ ডেঙ্গিদর্শন। অনন্য সম্মান নিয়েই লিখতে চাইছি, কিন্তু ডেঙ্গি হওয়া পরে আমার মাথার ঘিলুটা খানিক এঙ্গিপেঙ্গি হয়ে গিয়েছে। তার ওপর, অনন্য সম্মান সচক্ষে দেখার পর থেকে চিন্তাভাবনা গুলোও কেমন যেন জট পাকিয়ে গিয়েছে।
লেখার আগে খানিক ফ্ল্যাশব্যাকে যাই। গত পাঁচ-ছ বছর ধরে চাকরিসূত্রে আমি পূর্বভারতের এক বিখ্যাত অ্যাওয়ার্ড ফাংশনের নানা ধরনের দায়িত্বে ছিলাম। সেইসব ব্যক্তিত্বরাই সেখানে আমন্ত্রিত ছিলেন, যাঁদের পোশাকি নাম সেলিব্রিটি, যাঁরা সর্বদা আলো আর ছাতার তলায় থাকতে ব্যাকুল আর অন্ধকারকে যাঁরা বোলতাজ্ঞানে ঘৃণা করেন। সামনের সিটে বসতে না দিলে অনুষ্ঠানে আসেন না। এবং অন্ধের মতো ক্যামেরার চোখে পড়ার চেষ্টা করেন। মূলত এঁদেরকে ডেকেই আয়োজন করা হত এই সম্মান অনুষ্ঠানের। একবার যা মুশকিলে পড়েছিলাম কী বলব! ক'বছরে মান খানিক পড়ে যাচ্ছে বলে, যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে সেবার প্রথম কান-স্টাইলে (কান= Cannes) রেড কার্পেট ইন্ট্রোডিউস করা হল। সেলিব্রিটিরা যাতে মা লক্ষ্মী মা দুর্গা কার্তিকের মতো না সেজে খানিক অঙ্গশোভা প্রদর্শন করে হেঁটে যেতে পারেন। জোলি কিংবা জে লোর মতো স্মার্ট হয়ে। কিন্তু সেলিব্রিটির ওজন কিলোদরে মাপা হয়। ভারী-কম ভারী-হালকা। তার ওপর মুম্বই থেকে 'মণ'-ওজনের সেলিব্রিটিরা আসবেন। সব্বাই যদি রেড কার্পেট দিয়ে হেঁটে যান তবে তো মুড়ি মিছরি সমদর। রেড কার্পেটের কোনও ইয়ে থাকে না। অতএব বাছাইপর্ব। আমর মতো উলুখাগড়াদের ওপর গুরুদায়িত্ব- যাঁদের নাম বাদপড়ল তাঁদের কায়দা করে অন্য গেট দিয়ে ঢুকিয়ে দিতে হবে, যাতে তাঁদের আত্মাভিমান চোট না পায়, আর আত্মীয়তাও বজায় থাকে। ডিনার কার্ড-ও হরির লুঠের বাতাসার মতো বিলি হবে না। বাজেট টাইট। অপ্রত্যাশিত অতিথি নির্মমভাবে পরিত্যাজ্য। মুখ চেনা না হলে ঢোকা বন্ধ। ঢোকার আগে কাঁচের বয়ামে ডিনার কার্ড ফেলা মাস্ট।
এইবারে বুঝলাম কেমন শাঁখের করাত! রেড কার্পেটে লেখা অ্যাডমিট টু। মানে সস্বামী/সস্ত্রীক আমন্ত্রণ। কিন্তু ডিনার কার্ড বরাদ্দ হল একটি। কেন? না, অমুক সেলিব্রিটির স্ত্রী/স্বামী পরিচিত মুখ নন। ডিনারে নট অ্যালাউড। অডিটোরিয়াম ভরানোর জন্য বসতে পারেন। আমার কপালটাও এমন, বন্ধুপ্রতিম এক মেজ-ওজনের সেলিব্রিটি হঠাত্ তেড়ে বাঙালিসুলভ ইংরেজিতে চিত্কার চ্যাঁচামেচি শুরু করলেন, এভাবে অপমান করলি কেন? সামনের সিটে বসাবি বলে ডাকলি আর পাঁচ নম্বরে বসতে দিয়েছিস! একটা ডিনার কার্ড দিয়েছিস আবার চেক করছিস। এর মানেটা কী? আমি ডিনার করব আর আমার ওয়াইফ কি গাড়িতে বসে মশার কামড় খাবে? রেখে দে তোদের ডিনার। আমি চললাম। দৌড়ে গেলাম বসের কাছে। কী উপায়! নো উপায়। নিয়ম নিয়ম। ওরকম দু-চারটে মুখ বাদ পড়লে স্পনসরের কিছু না। মার্ক করে রাখো। ছবি ছোট করে দিও।
পণ্ডিত শিবকুমার শর্মাকে সামনের সারির সোফায় বসিয়ে হাঁফ ছেড়েছি! সেই সেলিব্রিটিকে দেখলাম জনসমুদ্রে। বিবেকানন্দের মতো জোড়কনুই হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এককোণে। অনন্য সম্মানের অনুষ্ঠানে আলো হয়ে আছে মঞ্চ। আইটিসির পালায় গিজগিজে ভিড়। ফার্স্ট-কাম-ফার্স্ট-সার্ভড বেসিসে সিট ভরে গিয়েছে। দাঁড়িয়ে আছেন প্রায় সমসংখ্যক দর্শক। আমি ইশারায় বললাম, তুই দাঁড়িয়ে যে! সিট ব্যবস্থা করছি। আমায় হাসিমুখে হাত তুলে আশ্বস্ত করলেন তিনি। চাপ নিস না, আমি ঠিক আছি। পাশাপাশি আরও কয়েকটি হাতও উঠল, যাঁদের মুখগুলো প্রাতঃস্মরণীয়। প্রায় রোজ সকালেই দেখা যায় খবর কাগজে...
সারি সারি মানুষের মাথার মধ্যেই এদিক ওদিক থেকে দেখা যাচ্ছে সুপরিচিত মুখ। শুধু আমার পরিচিত নন, এঁদের চেনে দেশবিদেশের মানুষ। তাঁরা এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছেন না তাঁদের এভাবে কেউ দেখে ফেলছে কিনা, কিংবা একটু-বেশি বেশি করে দেখছে কিনা তাঁরা এই মুহূর্তে ধরাছোঁয়ার মধ্যে বলে। অন্য সব দর্শকের মতোই তাঁদের চোখ স্থির মঞ্চের দিকে। বিত্তহীন মহানায়ক-মহানায়িকারা তখন একে একে মঞ্চ আলো করে আসছেন। সূতির কাপড়ে। সস্তার সাবানে চটা রং, একমাত্র না-ছেঁড়া শার্ট পরে। কিংবা গেল-বারের পুজোয় পাওয়া সালোয়ার কামিজ পরে। আবহসঙ্গীতের মূর্ছনা, স্পটলাইটের গোল আলো তখন সেলিব্রিটি ছেড়ে তাঁদের মাথার ওপরে।
পাঠকেরা চোখ বুজুন। ভাবুন, আপনার বাড়িতে ঠিকে কাজ করেন যিনি, তাঁকে হঠাত্ দেখলেন, মঞ্চে সারাজীবনের অবদানের জন্য পাচ্ছেন আস্ত একটা ট্রোফি, চেক আর সম্মানপত্র। দর্শকাসন থেকে শর্বরী দত্ত, মমতা শঙ্কর, গার্গী রায়চৌধুরী, দোলন রায়, অনুপম রায় উঠে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন! হাততালির আওয়াজে কানের পরদা ফেটে যাচ্ছে। কষ্টকল্পনা নয়, সচক্ষে দেখলাম অনন্য সম্মানের মঞ্চে। চার ফুটের একটু বেশি উচ্চতার এই হিম্মতওয়ালি। অন্তরের সৌন্দর্যে বলীয়ান। তিন টাকা চার আনা মাসমাইনেতে বাড়ি বাড়ি কাজ করতেন যখন, তিন-তিনটে বাচ্চার পেট সামলেও তিল তিল করে এক লক্ষ টাকা জমিয়ে জমিটি কিনেছিলেন হাসপাতাল বানানোর জন্য। ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে ডাক্তার করেছেন। মাইক্রোফোনে বললেন সুভাষিণী মিস্ত্রি, কারু কাছ থেকে এক বস্তা সিমেন্ট কারু কাচ থেকে ইঁট বাঁশ এই দিয়ে একটা হাসপাতাল তৈরি করিচি... মনে হল, আমরা যারা বাংলা জানি বলে কুঁকড়ে থাকি, ইংরিজি জানি বলে গর্ব করি তাঁদের তিনি অন্য একটা ভাষা শেখাচ্ছেন। রপ্ত করা বড় কঠিন। আমরা যারা লক্ষ টাকা পেলেই রাজারহাটের ফ্ল্যাট কিংবা শেভ্রোলের স্বপ্ন দেখি, তাদের বিবেকে হাতুড়ির ঘা পড়ছে যেন। স্বপ্নকে এমন তাড়া করার বুকের পাটা! কার আছে বলুন তো? আমরা যারা খবর করি, কোটিপতিরা কেমন শূন্য থেকে শুরু করেছেন, সেইসব বানানো মশলাদার স্টোরিগুলো কেমন গ্যাসবেলুনের মতো উড়ে যাচ্ছে!
সোনার মেডেল পাওয়া হয়ে গিয়েছে। এশিয়াডেও আশাতীত সাফল্য। একটা চাকরি জুটিয়ে নিতে পারলে আর বাড়ি বাড়ি কাজ করতে হবে না। জানতেন কী ইনিই বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী মহিলা? যে শক্তির ইংরিজি প্রতিশব্দ বোল্ড নয়। স্ট্রং। মঞ্জুরী ভাস্কর। ভারোত্তোলনে চ্যাম্পিয়ন এই মেয়ে এখনও সংসারের ভার বয়ে চলেছে ঐ কাজ করে। স্পনসরদের কাছে এমন ব্রাত্য একটি খেলা, আবার ভাগ্যও কেমন খেল খেলে রেখেছেন! এই মেয়েটিও স্টেজ আলো করে পেল অনন্য সাধারণ সম্মান। এবারেও কী জুটবে, পোল্যান্ড ইউ এস এ তে আরও বড় প্রতিযোগিতায় খেলার জন্য সহৃদয় স্পনসর? আর কত পরীক্ষা দিলে আর ঘর মোছা, বাসন মাজার কাজ? আর কত সম্মান পেলে তবে পাওয়া যাবে একটা সম্মানের চাকরি?
রাস্তার হঠাত্ রক্তাক্ত মানুষ দেখলে আমরা কজন তাঁকে উঠিয়ে নিই নিজের গাড়িতে? সামনের হাসপাতালে দ্রুত পৌঁছে দেওয়ার জন্য। মাথা খারাপ? সিটে রক্ত লেগে যাবে না? তার ওপর কী না কী ছোঁয়াচে রোগ থাকতে পারে। ঝামেলায় জড়িয়ে লাভ কী! দিনভর, ভরা ট্রেনে হকারি করে একটা বাইক কিনেছিলেন বিশ্বজিত্ বিশ্বাস। সারাদিনে কটাই বা বিক্রি গলা চিরে বিজ্ঞাপন করে? তবু বাইকের পেছনে লাগিয়ে দিলেন স্টিকার- Free ambulance। গ্রামগঞ্জের মুমূর্ষু রোগীকে দূরদূরান্ত থেকে পৌঁছে দেন হাসপাতালে। প্রাণ হাতে করে বাইক ছোটান প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে। পাশে সর্বক্ষণের সঙ্গী তাঁর স্ত্রী। তিনিও পেশায় হকার।
আরও কত বলব? এতটুকু বলেই আমার ডেঙ্গির আফটার-এফেক্ট বোতল-খোলা পারফিউমের মতো উবে গিয়েছে। কনফিডেন্সের পারদটা এমন চড়ে গিয়েছে যে এখুনি গিয়ে ফুটবল অ্যাকাডেমিতে নাম লেখাতে ইচ্ছে করছে। প্রবল করতালি সহযোগে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়, পন্ডিত শিবকুমার শর্মা এবং সবশেষে মান্না দে। উজ্জ্বল তারকাখচিত এক অ্যাওয়ার্ড ফাংশন শেষ হল একটিও নাচগান ছাড়াই! তবু একটিও দর্শক মাঝপথে উঠে যাননি।
বাকি ছিল আরও। ককটেল ডিনার। আমার একান্ত নিজস্ব পরিভাষায়, ককটেল প্লাস ল্যাভিশ ডিনার উইথ ইল্যাবরেট ডেজার্ট! কিন্তু এ কী কান্ড! কাতারে কাতারে লোক। পিলপিল করে সবাই ডিনার-মুখী! মেস হয়ে যাবে তো! দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। নাঃ, ভয়ের কিচ্ছু নেই। অতিথিরা কেউ অভুক্ত থাকবেন না। আহা, সে কী দৃশ্য একই ডিনার স্প্রেড থেকে হাতায় করে পাতে নিচ্ছেন বিরিয়ানি, মুর্গ মুসল্লম, মাটন রোগানজোশ। হুজ হু-র পাশে হা-ঘরে। ডিজাইনারওয়্যারের পাশে শস্তার হাট থেকে কেনা শার্ট। সবাই আস্বাদ নিচ্ছেন পেট ভরে। টেলিভিশন অভিনেত্রীর ঠিক পাশেই বসে ভাইয়ের সঙ্গে ম্যাঙ্গো পুডিং ভাগ করে নিচ্ছে এক রোগা-সোগা ছেলে। জিভের প্রথম স্বাদ একসাথে দুজনের। শুভঙ্কর বিশ্বাস। চিনতে পারলেন না? আরে এ-ই তো একট্রেন যাত্রীকে বাঁচিয়েছিল। ফিশপ্লেট খোলা ছিল দেখে মায়ের লাল শাড়িটা উড়িয়েছিল। হ্যান্ডশেক করে নিন দাদা। পাশে দাঁড়িয়ে মোবাইলে ছবি তুলে রেখে নিন। এদের দেখা সহজে পাওয়া যায় না!
স্বর্গীয় অনুভূতির আরও বাকি ছিল। শিবকুমার শর্মার সন্তুর আমাদের এক ঘন্টার জন্য পৌছে দিয়েছিল স্বর্গে। জীবনে প্রথমবার। কলকাতার এক স্বনামধন্য শিল্পী বললেন, যদি নাও ডাকো, অনন্য সম্মান দেখতে আসব। প্রতি বছর।
পুনঃ "মানি ইজ নট এভরিথিং। আ ডে উইল কাম হোয়েন ইউ উড নট নিড ইট এনি মোর।" সঙ্গীত, বলিউড, জীবন ও অনন্য সম্মান নিয়ে অনেক আলোচনার পর বললেন পন্ডিত শিবকুমার শর্মা।
রাজারহাটের রাস্তা দিয়ে ছুটছে গাড়ি। এয়ারপোর্টের দিকে। মুম্বইয়ের ফ্লাইট ধরতে হবে।
আমি বললাম, "সত্যি। কাল অনন্য সম্মান দেখে আরও বেশি মনে হল।"
"লোকে বড়াই করে বলে, আমার সেভেন বেডরুম ফ্ল্যাট আছে। সিক্স বেডরুম বাংলো আছে। সত্যিটা হল, মানুয যখন ঘুমোয়, তখন একটাই বেডরুম, একটাই বেড লাগে। সাতটা বেডরুম তো একসঙ্গে ভোগ করতে পারে না। থেকে কী লাভ!" জানলার বাইরে চোখ রেখে বললেন তিনি।
মন্তব্যটা চেষ্টা করেও ভুলতে পারব না!
ফুলকলি