স্বর্গে জন্মদিনে ৭ প্রশ্নের উত্তর দিলেন 'বব উলমার'
স্বরূপ দত্ত
আজ পৃথিবীতে থাকলে তাঁর বয়স হতো ৬৮ বছর। তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছেন তো কী! আজ তাঁর জন্মদিন। তাই কল্পনার ফ্লাইটে চেপে দিব্যি পাড়ি দিলাম ববের নতুন আস্তানার উদ্দেশ্যে। বব মানে যে বব উলমার সেটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝে গিয়েছেন। হ্যাঁ, জন্মদিনে ববের একটা ইন্টারভিউ করার ইচ্ছে হল। তাই তো ইচ্ছে ডানায় ভর করে পৌঁছে গেলাম তাঁর কাছে।
পরিবেশ বদলেছে। ববের চারপাশে এই পৃথিবীর দূষিত হওয়া আর বয় না। ববের আজকের চারপাশটায় আর সেই হিংস্র মানুষগুলো নেই। ল্যাপটপ কোচের চোখমুখ দেখে অনেক বেশি শান্তিতে রয়েছেন বলে মনে হল। বললাম, আপনার জন্মভূমি থেকে আসছি। তবে, কানপুর নয়, কলকাতা থেকে। এখন আর কথা বলেন না কারও সঙ্গে তেমন। পৃথিবীর 'মানুষ' হলে তো সটান না। কিন্তু এত আকুল প্রার্থনায় ল্যাপটপ কোচের যান্ত্রিক মনও গলল বোধহয়। কিছু তো আর বলে গেলেন না শেষ বেলায়। তাই অনেক জোরাজুরিতে বসলেন সামনে। মুচকি হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে। বললাম, মাত্র ৭ টা প্রশ্নের উত্তর নেবো আর খানিক গল্প। হল শুরু...কথপোকথনের।
১) ঠিক কী হয়েছিল সেই রাতে? হোটেলের ঘরে? ২০০৭ বিশ্বকাপের আসরে মারা গেলেন! কিন্তু কীভাবে কেউ জানলো না আজও!
বব - হাঃ, হাঃ, সবই যদি আমি বলে দেব, তাহলে তো আমার পৃথিবীতেই থাকার দরকার ছিল আজও। আসলে ভারতে আমি জন্মেছিলাম, ভালোলাগা আছে অনেক ও দেশ সম্পর্কে। কিন্তু ভারতের পুলিশের বড্ড বদনাম। আমার মৃত্যুর পর গোটা পৃথিবীর পুলিশগুলোকে দেখে বুঝলাম, বোগাস। আসলে সব দেশের সব পুলিশ ইন্টারপোল এখন বোগাস! না হলে, আমার মৃত্যুর ৯ বছর পরও কেউ বলতে পারলো না যে, কীভাবে মারা গেলাম! আরে মশাই, দেখুন আরও কয়েক বছর। আমি তো সব জানিই। আপনারা আর একটু সময় নিয়ে দেখুন পৃথিবীর সব গোয়েন্দারা কী উদ্ধার করে। এখানে শার্লক হোমসের সৃষ্টিকর্তা কোনান ডয়েলের সঙ্গে কথা হয় মাঝে মাঝে। কোনানও তো নিজে খুব ভালো ক্রিকেট খেলতো। তা, ও সে বলে, কোনও তদন্তেরই দরকার নেই। আমার মৃত্যু রহস্য জলের মতো পরিষ্কার!
২) আজও দক্ষিণ আফ্রিকা চোকার্স তকমা গা থেকে মুছতে পারল না!
বব - আজও পারল না। কাল পারবে। না হলে পরশু পারবে। আর জানবেন, যেদিন লকগেটটা একবার খুলে যাবে, সেদিন থেকে কিন্তু ক্রিকেটের ৮০ শতাংশ ট্রফি নিয়ে যাবে দক্ষিণ আফ্রিকা। এতদিনের তৃষ্ণা। একবার শুরু করলে, সব ঢকঢক করে গিলে খাবে। ওরা জিতছে না, সেই ১৯৯২ থেকেই। কিন্তু আপনি কোনওদিনও বলতে পারবেন না যে ওরা জেতার যোগ্য না! হয় এ পৃথিবীতে কিছু জিনিস যার যুক্তি দিয়ে উত্তর দেওয়া যায় না। শুধু বিশ্বাস করে যেতে হয়। আর প্রত্যেক দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষ বিশ্বাস করে, সাফল্য তাদের আসবেই। নেলসন ম্যান্ডেলার থেকে এটা খুব বেশি করে শিখে নিয়েছে ওরা। একা গোটা জীবন দ্বীপের কুঠুরিতে থেকেও লোকটা হেরে যাননি। তাহলে এবি-রা কেন হেরে যাবে! সবুরে মেওয়া ফলে বুঝলেন।
৩) আইপিএলে কোচিং করাতে ইচ্ছে করে না? ২০০৭ এ আপনি চলে গেলেন আর পরের বছর থেকেই শুরু আইপিএল!
বব - একেই বলে কপাল! দেখুন, জাতীয় দলের কোচিং করানোর মজাই আলাদা। ওখানে একটা গোটা দেশের মানুষের আবেগ জড়িয়ে থাকে। একটা জাতি জেগে ওঠে দেশের সাফল্যে। আবার এটাও ঠিক যে, ব্যবসায়ীরা যখন কোনও জিনিসে টাকা আর মন দুটোই ঢালেন, তখন একটা সামাজিক প্রভাব তো পড়েই। হুম, পৃথিবীতে থাকলে নিশ্চয়ই হয়তো আপনাদের আইপিএলের কোনও একটা দলের কোচিং করানোর প্রস্তাব পেতাম। কিন্তু পাকিস্তানে গিয়ে বুঝেছিলাম, পৃথিবীতে আসলে দুটো মহাদেশ। একটায় সব, আরকেটায় 'উপমহাদেশ'। এই তো সেদিন প্যাকার বলছিল, ও এখানেও একটা ক্রিকেট লিগ শুরু করতে চায়। বললাম এগিয়ে যাও বন্ধু। সঙ্গে আছি।
৪) ভারতীয় দলের কোচ খোঁজা হচ্ছে। একটা আবেদন করবেন না?
বব - মারবেন নাকি! উপমহাদেশে আর না। একদম না। এই ঠিক আছি। আর তারউপর এখনকার সমাজে আর হ্যান্সিদের মতো ছেলে খুঁজে পাওয়া যায় না বুঝলেন। হ্যান্সিকে যা বলতাম, সব মন দিয়ে শুনতো। আপনাদের বিরাটকে তো দেখে মনে হয় না যে, ও অন্যের কথা খুব শুনে টুনে চলতো। তবে, ছেলেটার ব্যাটিং দেখে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি। আমি ওর দুর্বলতাও ধরে ফেলেছি। ল্যাপটপে রাখা আছে । কিন্তু শেখাবো কাকে! তবে, আপনার কানে কানে বলে দিই, বিরাটের দুর্বলতা কী জানেন? ওর ব্যাট আর প্যাডে যে পরিমাণ ফাঁক থাকে, তা পৃথিবীর কোনও সেরা ব্যাটসম্যানের থাকে না। কিন্তু বিরাটের এখন সময়টা এত ভালো যাচ্ছে যে, ওই ফাঁক কারও চোখে পড়ছে না। ব্যাড প্যাচ শুরু হলে কিন্তু বিরাট ওই ফাঁক দিয়ে প্রচুর বল উইকেট থেকে বেল নিয়ে চলে যাবে!
৫) পিঙ্ক বলে টেস্ট দেখলেন?
বব - ছ্যা, ছ্যা, ক্রিকেটটা শেষ হয়ে গেল বুঝলেন। আমি নিজে ক্রিকেটে প্রযুক্তি ব্যবহারের পক্ষে। কিন্তু বলটার রঙই পাল্টে দেবে! আরে ওই লাল বলটায় তো আগুন থাকে। ওটাই তো পৌরুষ। ক্রিকেট এখন ওই পিঙ্ক বলের জন্য 'সমকামী রঙা' হয়ে গেল বলে মনে হচ্ছে। আমি দিন-রাতের টেস্টের পক্ষে। কিন্তু কিছুতেই বলের রঙটা লাল থেকে বদলে গোলাপি করার পক্ষে নই।
৬) হ্যান্সির কী খবর?
বব - রোজই কথা হয়। ঠিক সকাল বিকেল একবার দেখা করে যাবে। শেখার ইচ্ছেটা আজও একইরকম। জানেন তো সেই ইয়ার প্লাগটা আজও কানে গুঁজে রাখে। এতটাই সম্মান করে আজও আমায়। কিন্তু ছেলেটার মনে খুব দুঃখ। মাঝে-মাঝে দুঃখ করে বলে, গা থেকে গড়াপেটার দাগটা আর তোলা হল না। আজাহার দিব্যি নিজের জায়গাটা ফিরে পাচ্ছে। ওকে নিয়ে সিনেমা টিনেমাও হচ্ছে। আর আমাকে লোকে ভুলেই গেল। আর মনে রাখলেও খলনায়ক হিসেবেই। পাশে থাকি ওর। বলি, পৃথিবীতে সত্যি কথা বললে এমনই ফল হয় আজকাল। লুকিয়ে রাখো। মিথ্যে বলো। তাহলে বিচার পাবে।
৭) শেষ প্রশ্ন। অনেকদিন তো হল, এবার নিশ্চয়ই আবার জন্ম নেবেন। কোন দেশে জন্ম নেবেন এবার?
বব - কোথায় আবার? জামাইকার যে হোটেলের ঘরটায় শেষবার নিঃশ্বাস নিয়েছিলাম, সেই ঘরটাতেই যেন জন্ম হয় আবার। মনে হবে জীবনের সিক্যুয়েল শুরু হল। অবশ্যই বাবা-মা হিসেবে চাই আগের বারের বাবা-মাকেই। নেলসন ম্যান্ডেলা যে দেশে জন্মান, নিজের জন্মভূমি বাছার সুযোগ থাকলে, অন্য দেশের কথা কেউ ভাবে নাকি! আর ভাবলেও সেটা অবশ্যই ইংল্যান্ড।
সাক্ষাত্কার শেষে চলে আসার সময় ববের মনটা দেখলাম খারাপ হয়ে গেল। বললেন, চলে যাবেন? অনেকদিন বাদে পৃথিবীর লোকের সঙ্গে দেখা হল। গিয়ে সবাইকে বলবেন, বব পৃথিবীর তিনটে জিনিস কখনও ভুলবে না। ক্রিকেট, ক্রিকেট আর ক্রিকেট। বলে এলাম, আমিও ভুলবো না বব তোমাকে।
(এটাও কী বলে দিতে হবে যে, এটা কাল্পনিক! ইস আক্ষেপ যদি কাল্পনিক না হতো.....)