সেলফি তোলার সময় সবাই মুখ বিকৃত করে কেন জানুন

Updated By: Aug 7, 2016, 07:56 PM IST
সেলফি তোলার সময় সবাই মুখ বিকৃত করে কেন জানুন

ঝুমুর দাস

আজ বাইশে শ্রাবণ। দেখতে দেখতে ৭৫টা বছর পেরিয়ে গেল আমরা কবিগুরুকে হারিয়েছি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো শুধুমাত্র বাংলা কিংবা বাঙালির মধ্যেই আবদ্ধ ছিলেন না। তাঁর প্রভাব গোটা বিশ্বজুড়ে। তাই তো তিনি বিশ্বকবি। আজ আমরা কিংবা আমাদের সমাজ পুরোটাই তাঁর সৃষ্টিতে আবদ্ধ। তাঁরই লেখা 'সহজ পাঠ' পড়ে আমাদের শিক্ষা শুরু হয়। 'সহজ পাঠ', অর্থাত্‌, যে পাঠ সহজে গ্রহণ করা যায়। অর্থাত্‌, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের শিক্ষার শুরু, একইসঙ্গে জীবনের শুরুটা 'সহজ পাঠ'-এর মাধ্যমে সহজভাবে শুরু করার ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছিলেন। আমরা প্রত্যেকেই 'সহজ পাঠ' পড়েছি। কিন্তু তা শুধুমাত্র পড়ার জন্যই পড়েছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেন 'সহজ পাঠ' নাম দিয়েছিলেন, তার আসল মর্মটাই বুঝতে পারিনি। তাই আমাদের সমাজ এবং আমাদের জীবন মোটেই সহজ নয়, বরং পুরোটাই বাঁকা। আরও বাঁকা হচ্ছে, প্রতিনিয়ত।

এবার আসি আসল প্রসঙ্গে। প্রথমত, আজ এমন একজনের মৃত্যুবার্ষিকী, যাঁর সৃষ্টি আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, মজ্জায় মজ্জায় রয়েছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যাঁর সৃষ্টি ছাড়া আমাদের অস্তিত্ব 'সংকটে' পড়ে যায়। এই যে আমরা শিক্ষিত বলে এত গর্ববোধ করি, তার সিংহভাগটাই তাঁর জন্য সম্ভব হয়েছে। তবু, ক্লাসে সেরা হওয়া ছেলে বা মেয়েটি থেকে শুরু করে যে যখন সেরা হওয়ার স্বীকৃতি পেয়েছেন, পুরষ্কার নেওয়ার সময় মঞ্চে দাঁড়িয়ে বাবা-মা-শিক্ষক-শিক্ষিকা কিংবা যাঁর যত অবদান সবার নাম করেছেন। (নিশ্চয়ই তাঁদের অবদান রয়েছে। সেটাও অস্বীকার করছি না।) কিন্তু ঘুণাক্ষরেও কারও মুখে একবারও সেই মানুষটার নাম ফুটে ওঠেনি, যাঁর লেখা পড়ে তিনি শিক্ষার শুরু করেছেন।(অবশ্য এক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়ও রয়েছে) দ্বিতীয়ত, তিনি সেই যুগে বসে এই যুগের সমাজের ছবিটা লেখার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তাঁর থেকে বড় ভবিষ্যত্‌বক্তা আর কে আছেন? তাই তিনি যেমন 'সহজ পাঠ' রচনা করেছিলেন, তেমনি ভবিষ্যত্‌ সমাজের চেহারাটা কল্পনা করে লিখে গিয়েছিলেন, 'সহজ কথা যায় না বলা সহজে'।

সত্যিই, আজ আমরা বড়ই বাঁকা। কোনও কিছুই সহজভাবে করতে পারি না। না সহজভাবে বলতে পারি, না সহজভাবে লিখতে পারি আর না সহজভাবে ভাবতে পারি। এখন আমরা মজ্জাগতভাবে এতটাই বেঁকে গিয়েছি যে, ছবি তোলার সময়েও আমাদের মুখ বিকৃত করে তুলতে হয়! ওটাকে নাকি আধুনির ভাষায় 'পোজ' বলে। তবে, কোথাও কিন্তু বলা নেই 'পোজ' মানেই তা বিকৃত হতে হবে। আসলে সমাজের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অন্তরের বিকৃতি ঘটে গিয়েছে অবচেতনভাবেই।

সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে আজ বিশ্বের নামী-অনামী-কুখ্যাত-বিখ্যাত সবাই আমাদের 'সো কলড ফ্রেন্ড'। বিশ্বটা আরও বেশি হাতের মুঠোয়। তাই আমাদের চারপাশে এবং সেই সোশ্যাল মিডিয়ার জগতের দিকে তাকালেই এখন 'সেলফি'র ভিড় দেখা যায়। সবাই এখন সেলফি জ্বরে আক্রান্ত। যে, যেমন অবস্থায় থাকছে, টুক করে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে 'পোজ' দিয়ে দিচ্ছে। আর খচাখচ্ ছবি উঠে তা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট হয়ে যাচ্ছে। এই সেলফির দুনিয়ায়, যে যেমন মানুষই হন না কেন, একটা জিনিস 'কমন'। মোটামুটি সিংহভাগেরই সেলফি তোলার কায়দা এক। বিকৃত মুখ।

ট্রেনে বাসে রাস্তাঘাটে যাতায়াত করতে করতে কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় রোজ এই ধরনের ছবি দেখে আমার মনেও কয়েকটা প্রশ্ন জেগেছে।
১) সেলফি মানেই কি বিকৃত মুখ হতে হবে?
২) কেন সেলফি তোলার সময় আমাদের চোখ মুখ এবং বিকৃত অঙ্গভঙ্গী করতে হবে? এতে কি সেলফির মান আরও বাড়ে? যদি বাড়ে তাহলে কীভাবে? আর যদি না বাড়ে, তাহলে কেন এমন করার প্রয়োজন হয়?

বলা হয়, আমাদের মুখ নাকি আমাদের চরিত্র প্রকাশ করে। মুখ দেখেই নাকি মানুষের মন বলে দেওয়া সম্ভব। তাহলে যে মুখ বেঁকে থাকে, সেই মুখের মনও যে বাঁকা হবে, সেটাই স্বাভাবিক। আর সেটাই আমাদের সেলফি তোলার কায়দা থেকে প্রমাণিত হয়। সেলফি বা নিজের ছবি নিজে তোলার প্রচলন তো সেই ১৮৩৯ সালে রবার্ট কর্নিলিয়াস করেছিলেন। পরবর্তীকালে ১৯০০ সালে এক মহিলা আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের ছবি নিজে তুলেছিলেন। অর্থাত্‌, এই যে এখন সেলফি নিয়ে এত মাতামাতি হয়, তা মোটেই নতুন কোনও বিষয় নয়। যদিও তখন স্মার্টফোন আসেনি। যত দিন পেরিয়েছে, সমাজে পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন এসেছে আমাদের মনেও। পরিবর্তন এসেছে সেলফিতেও। মানুষের মনের মতো সেলফিও আজ সোজা থেকে বেঁকে গিয়েছে। আসলে সেলফি বাঁকেনি। মানুষের মন নিজের বিকৃত মনের সঙ্গে মিলিয়ে সেলফিকে বিকৃত করে দিয়েছে। তাই আবারও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা কবিতার লাইন সত্য বলে প্রমাণিত হল। তাঁরই মতো করে আমারও বলতে ইচ্ছে করছে। 'সহজ সেলফি, যায় না তোলা সহজে'।

আরও পড়ুন আমি টিভিতে নতুন সিনেমা দেখতে পারি না, আপনি পারেন তো?

.