যে সন্ধ্যা ভুলিনি
সে অনেক দিন আগেকার কথা। বছর কুড়ি হবে। তখন 'প্রাইমারি ইস্কুলে' পড়ি। আমাদের চারপাশে কিছু মানুষ থাকেন, যাঁদের প্রাথমিক ভাবে তুচ্ছ বলে মনে হয়। অনেক সময় অস্তিত্বের সাড়াও পাওয়া যায় না। সময় গড়ালে বোঝা যায়, কত গভীরে শিকড় গেড়েছে সে। বিশ্ব নারী দিবসের আগে তেমনই একজনের কথা মনে পড়ে গেল। একেবারে কাকতালীয় ভাবে।
সে অনেক দিন আগেকার কথা। বছর কুড়ি হবে। তখন 'প্রাইমারি ইস্কুলে' পড়ি। আমাদের চারপাশে কিছু মানুষ থাকেন, যাঁদের প্রাথমিক ভাবে তুচ্ছ বলে মনে হয়। অনেক সময় অস্তিত্বের সাড়াও পাওয়া যায় না। সময় গড়ালে বোঝা যায়, কত গভীরে শিকড় গেড়েছে সে। বিশ্ব নারী দিবসের আগে তেমনই একজনের কথা মনে পড়ে গেল। একেবারে কাকতালীয় ভাবে।
গ্রামে তখন একটাই প্রাইভেট প্রাইমারি স্কুল ছিল। তার প্রতিষ্ঠাতা ভদ্রলোক আবার আমার বাবার অনুজপ্রতীম। তাঁর অনুরোধে বাবা আমাকে আর ভাইকে দিলেন সেখানে ভর্তি করে। একটা টিনের দোচালা ঘর, আরও কয়েকটা ঘর নিয়ে ভদ্রলোকের বাড়িতেই চলত ইস্কুল। সামনে ছিল একটা ছোট উঠোন। কোনও ক্লাসে ছাত্র ছিল কুড়ি জন, কোনওটায় হয়তো আর একটু বেশি। তা বলে হুল্লোড়ের খামতি ছিল না। ফাঁক পেলেই শুরু হয়ে যেত খেলা। নিত্যদিন নতুন নতুন খেলা আমদানি করত এক এক জন সহপাঠী। খেলত না শুধু একজন।
আমাদের সঙ্গেই পড়ত একটি মেয়ে। নাম সন্ধ্যা। দেখলেই বোঝা যেত, বয়সে সে বেশ খানিকটা বড় আমাদের থেকে। চেহারায়, চলনে গ্রাম্যতার ছাপ স্পষ্ট। বাগানের লতাগুল্মের মধ্যে যেমন ডাটা শাকের গাছে নিজ দোষে হোক বা গুণে, সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, সন্ধ্যাও তার ব্যতিক্রম হল না। ক্লাসের ফাঁকে আমরা যখন খেলায় মগ্ন, কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে যেত সে। বেশ কিছুদিন তদন্তের পর জানতে পারলাম, মেয়েটি থাকে ওই বাড়িতেই। বাড়ির বাচ্চাদের দেখভালের পাশাপাশি সংসারের টুকিটাকি কাজ করে। রহস্য আরও ঘনীভূত হল।
কোথা থেকে এল ও? কোথায় ওর বাড়ি? কোনও দিনও জিজ্ঞাসা করে উঠতে পারিনি। কৌতুহল নিবৃত্ত করতে পাছে আঘাত দিয়ে ফেলি। ভয়ের বেড়া টপকে বড়দেরও জিজ্ঞাসা করে ওঠা হয়নি কখনও। যদিও প্রশ্ন না-করতেই উত্তর পেলাম একদিন।
তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল, কোনও মনীষীর জন্মজয়ন্তী পালন করতে ইস্কুলের সামনে উঠোনটায় জড়ো হয়েছি আমরা। ছোট্ট মঞ্চে শুরু হল অনুষ্ঠান। কয়েকজনের গান ও আবৃত্তির পর মঞ্চে উঠল সেই মেয়েটি। এর আগে তাকে কোনও দিন মঞ্চে উঠতে দেখিনি। সঙ্গেই মঞ্চে উঠলেন প্রতিষ্ঠাতা ভদ্রলোক। সন্ধ্যার পাশে বসে বললেন, "ওর সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলার আছে। বছর কয়েক আগে একদিন সন্ধ্যা আমার বাড়িতে হাজির। বলল, আমি পড়তে চাই। আমাকে একটু পড়াবেন? পয়সা দিতে পারব না। বদলে ঘর মুছে দেব, বাসন মেজে দেব। তার পর থেকে ও আমাদের সঙ্গেই থাকে।" তখন কথাগুলো তেমন ভাবে আঁচড় কাটেনি বটে, কিন্তু সে পাঠশালা ছাড়ার পরেও ভুলে যাইনি। কারণ,প্রাথমিক কৌতুহল মিটলেও সামনে দাঁড়িয়েছিল আরও বড় একটা প্রশ্ন। ও জানল কী করে, পড়াশুনো কতটা জরুরি।
কলেজে পা দিয়ে একদিন দেখলাম সিলভার স্ক্রিনের ডানদিকে অ্যাপোলো ইলেভেনকে মহাকাশে পৌঁছে দিতে পৃথিবীর টানকে হেলায় হারিয়ে কেনেডি স্পেস সেন্টারের লঞ্চপ্যাড থেকে ক্রমশ ওপরে উঠে যাচ্ছে স্যাটার্ন ফাইভ রকেট। আর অন্যদিকে মাস্টারমশাইয়ের হাত ধরে ট্রেনে উঠছে লতি। সমাজের যাবতীয় বাঁধন ছিঁড়ে। ঠিক ধরেছেন, মন্দ মেয়ের উপাখ্যান। বুঝলাম, যারা বোঝে, তারা নিজে থেকেই বোঝে। আর যারা বোঝে না, তারা কোনও দিনই বুঝতে পারে না।
গ্রামের একটি অতি সাধারণ মেয়ে যে কতখানি গভীর আঁচড় কেটেছে, অনেক পরে বুঝেছি। যখনই আলস্যের আবেশে কোনও প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে কাজ সারার চেষ্টা করি, সন্ধ্যা সামনে এসে দাঁড়ায়। জানি না, সন্ধ্যার রবি উচ্চমাধ্যমিকের পরই অস্তাচলে গিয়েছে কি না। কিন্তু এটাই হয়তো তার জয়।
শুধু সন্ধ্যা নয়। কখনও মায়ের বেশে, কখনও স্ত্রীর বেশে, কখনও অন্য কোনও প্রিয়জন হয়ে, কখনও বা কেউ না-হয়েও নারীরা আমাদের অনুপ্রাণিত করেন। অথচ তাঁরা জানতেই পারেন না, তাঁরা জয়ী। কারণ, সে জয়ের কোনও প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই, সে জয়ে একটা সুন্দর পৃথিবী গড়ে ওঠে আগামীর জন্য।
পিনাকী ভট্টাচার্য