এখন ভারতীয় ক্রিকেটে সোম, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, ''রবি শাস্ত্রী''
স্বরূপ দত্ত
জেমস ফকনারকে ১৯তম ওভারে পরপর সবে দুটো চার মেরেছেন বিরাট কোহলি। তাতেও শেষ কোথায়! কারণ, পরের বলটা সোজা উড়ে গেল বাঁ দিকের গ্যারালারিতে। না, সেই মুহূর্তে ক্যামেরায় বিরাট বা ফকনারকে দেখা গেল না। দেখা গেল যে মাঝবয়সী ভদ্রলোককে, ডাগ আউটে তিনি তাঁর চেয়ারটায় আর একটু এলিয়ে দিলেন শরীরটাকে। আর হাত দুটো মাথার উপর তুলে তিনি একটু তালি দিলেন। বুকটা গেল চুপসে। মুখ থেকে বেরিয়ে গেল সামান্য কার্বন ডাই অক্সাইড। হ্যাঁ, তিনি রবি শাস্ত্রী। এই ইন্ডিয়ান টিমের অ্যাক্টিং ডিরেক্টর। যদি এই ডেজিগনেশন বুঝতে না পারেন, তাহলে কোচ বলতেই পারেন। রবিবারের মোহালিতে অস্ট্রেলিয়াকে বিরাট যেভাবে উড়িয়ে দিলেন, তাতে রবির শাস্ত্রীর জন্য কয়েকটা কথা মনে হচ্ছে। কারণ, ভারত আবারও একটা বিশ্বকাপ জয় থেকে মাত্র দুধাপ দূরে। তার আগে রবিকে নিয়ে যেগুলো অবশ্যই মনে পড়ল..কারণ, বিরাট, ধোনি, যুবরাজ, রোহিতরা এক একটা দিন। কিন্তু রবি শাস্ত্রী যে পুরো সপ্তাহটাই। শুধু চাই, এই বিশ্বকাপটা।
১) বুঝলে হে ফ্লেচার, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে - ১৯৮৩ সালের সেই প্রথম বিশ্বকাপজয়ী ভারতীয় দলের সদস্য রবি শাস্ত্রী। একটা তথ্য আপনাদের দিলে ভালো লাগবে। মনে আছে সেই বিশ্বকাপে ভারত-জিম্বাবোয়ে সেই রূপকথার ম্যাচটার কথা? ওই বিশ্বকাপের যে জিম্বাবোয়ে ম্যাচে অপরাজিত অবিশ্বাস্য ১৭৫ রান করেছিলেন কপিল দেব, সেই ম্যাচে খেলেছিলেন রবি শাস্ত্রীও। ৭৭ রানে ছ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর ক্যাপ্টেন কপিল দেবকে সঙ্গ দিতে ক্রিজে গিয়েছিলেন রবি। ৬ টা বল খেলে অবদান ছিল মাত্র ১ রান। জানেন, সেদিন রবির উইকেটটা কে নিয়ে গিয়েছিলেন? ডানকান ফ্লেচার! হ্যাঁ, রবি শাস্ত্রীর আগে আমাদের ভারতীয় দলের কোচ ডানকান ফ্লেচার! আর সেই রবি শাস্ত্রীই কিনা ২০১৪ সালে এসে ভারতীয় দলের দায়িত্ব নিচ্ছেন, ডানকান ফ্লেচারকে সরিয়ে! এটাকে কি ধর্মের কল বাতাসে নড়ে, বলবেন না? মনে মনে, ঠিক হাসছেন রবি। বলছেন, আর দুটো ধাপ পেরোতে পারলেই, ১৯৮৩-র মতো আরও একটা বিশ্বকাপজয়ী দলের সঙ্গে জড়িয়ে যাবেন তিনি। ফ্লেচারকে বোঝাতে পারবেন, কীভাবে ভারতীয় ক্রিকেটের 'উন্নয়নের' সময় নষ্ট করে গিয়েছেন তিনি।
২) ছয় ছক্কা - স্যার গ্যারফিল্ড সোবার্সের পর এই ক্রিকেটবিশ্ব শুনেছিল তাঁর নাম। রবি শাস্ত্রী। কেন? কারণ, স্যার গ্যারির পর এই গ্রহে তিনিই একমাত্র ছ বলে ছয় ছক্কা মেরেছিলেন। পরে ২০০৭ সালে এসে সেই রেকর্ড স্পর্ষ করলেন আরও এক ভারতীয়। যুবরাজ সিং! আর সেই যুবরাজ এবারের রবির দলেও। কফির পেয়ালায় চুমুক দেওয়ার আগে আর তো দুটো ঠোঁটের ফাঁক। সেটাতে যুবরাজ রবির কাছেও নিশ্চয়ই লাকি হয়ে থাকবেন। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যুবির ব্যাট যদি চলা শুরু করে, রবির সপ্তাহের সব দিনই যে তুঙ্গে হবে!
৩) আজ অনুষ্কা, হেজেলরা, সেদিনের অমৃতা সিং - আজ তাঁর দলের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেটার বিরাট কোহলি। তাঁর আজ গার্লফ্রেন্ড, কাল ব্রেক আপ অনুষ্কা শর্মার সঙ্গে। দলের অন্য তারকা সদস্য যুবরাজও সদ্য গাঁটছাড়া বেঁধেছেন হেজেল কিচের সঙ্গে। দুজনই বলিউড অ্যাকট্রেস। শুধু তাই কেন? এই ভারতীয় দলের আরও এক সদস্য কিছুদিন আগেই বিয়েটা সারলেন। হরভজন সিং। তাঁর স্ত্রী গীতাও তো বলিউড অ্যাকট্রেস। আজ এসব দেখেশুনে রবি মনে মনে ঠিক হাসেন। কারণ, তাঁর ক্রিকেট কেরিয়ারের শুরুর দিকে বলিউড অ্যাকট্রেস অমৃতা সিংকে নিয়ে তো কম গুঞ্জন ওঠেনি। অমৃতা সিংকে মনে পড়লো তো? সইফ আলি খানের প্রথম পক্ষের স্ত্রী! মানে, ওই অমিতাভের মর্দের মতোই অনেক ফিল্মের হিরোইন। মানে, কী দাঁড়ালো? আজ যেটা বিরাট, যুবরাজ বা হরভজনরা করছেন, সেই স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন রবি শাস্ত্রী। আজকের এই ইন্ডিয়ান টিম বয়সে যতই তরুণ হোক তাঁদের কোচের থেকে। বলতে বাঁধা নেই, মানসিকতাতে রবি, ওঁদের মতোই।
৪) আজ সুনীল গাভাসকর, হর্ষ ভোগলে, সঞ্জয় মঞ্জেরেকররা কী বলবেন কমেন্ট্রি বক্সে রবির সঙ্গে দেখা হলে - এই তো ২০১৪ সালে ভারতীয় দলের ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে রবি শাস্ত্রির ঘর বাড়ি ছিল, গোটা ক্রিকেটবিশ্বের সব স্টেডিয়ামের কমেন্ট্রি বক্স। অনর্গল ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যার সঙ্গে দুর্দান্ত কণ্ঠস্বর, রবিকে আলাদা জায়গা করে দিয়েছে। কোনও ম্যাচে ভারত জিতেছে আর রবির গলায় যদি সেই ধারাভাষ্য না শোনেন, তাহলে তো সবটাই ম্যাড়ম্যাড়ে। মানে, মেয়েটির মন জিতলেন, কিন্তু কোনওদিন তাঁর মুখে নিজের নামটা ধরে ডাকটা শুনলেন না! রবির জায়গা যে তাই। সেই রবি, তাঁর কমেন্ট্রি বক্সের সঙ্গীসাথীদের হঠাত্ করে ছেড়ে দিয়ে বড় দায়িত্ব শুধু নিলেন না। একেবারে বিশ্বকাপ জয়ের সাফল্য পাওয়া থেকে মাত্র দুধাপ দূরে। আজ সুনীল গাভাসকর রবিকে দেখে ঢোক গিলে বলবেন না যে, 'সেদিন পাকিস্তান ম্যাচে, পাকিস্তানকে ফেভারিট বলে ভুল করেছিলাম' অথবা, সঞ্জয় মঞ্জেরকর কী বলবেন না, 'রবি কমেন্ট্রি বক্সেও আমরা তোমার জন্য গর্ববোধ করছি!' আর হর্ষ ভোগলে তাঁর শোয়ে কীভাবে সম্মোধন করবেন, রবিকে! জানার বা দেখার অপেক্ষায় থাকলাম।
৫) বরাবরের ক্যাপ্টেন মেটেরিয়াল - ক্রিকেট কেরিয়ারে সবসময় বলা হতো রবি শাস্ত্রী দুর্দান্ত ক্যাপ্টেন হওয়ার ক্ষমতা ধরেন। কিন্তু কেরিয়ারে একটি টেস্ট ম্যাচ ছাড়া আর ভারতকে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পেলেন কোথায়! চোট তাঁকে অনেক পিছিয়ে দিল। আজ কপালের ফেরও তেমন। সেই মানুষটাই কোচিং করাচ্ছেন, দেশের সর্বকালের সেরা ক্যাপ্টেনকে! তাঁর ধুরন্ধর এবং প্রখর ক্রিকেটপ্রজ্ঞার পাত্রে আইসের টুকরোর মতোই সঙ্গে ক্যাপ্টেন কুলের ক্যারিশমা। এর সঙ্গে বিরাট কোহলি নামক এক সেরা ব্যাটসম্যান। যার বুকে রয়েছে একটা জালিয়ানওয়ালাবাগের বারুদ। এবং আগামীর ক্যাপ্টেন মেটেরিয়াল। এসব দেখেশুনে শাস্ত্রীর কি নিজের পুরোনোদিনগুলোতে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না? সেইজন্যই মনে হচ্ছে, রবি আরও একটা বিশ্বকাপজয়ী দলের সঙ্গে জড়িয়ে যেতে চলেছেন। বাকিটা সময় বলবে। আর তো মাত্র কয়েকটা দিন।