শঙ্খ ঘোষ যেন আজকের রাজাকেও প্রশ্ন করেন, বিচার দেবার আগে জেনে নাও প্রশ্ন করো তুমি কোন্ দল!

অনেক মৃত্যু শঙ্খ ঘোষকে কষ্ট দিয়েছে, দুঃখ দিয়েছে, কিন্তু তাঁকে ভাঙতে পারেনি।

Edited By: সৌমিত্র সেন | Updated By: Apr 21, 2021, 07:58 PM IST
শঙ্খ ঘোষ যেন আজকের রাজাকেও প্রশ্ন করেন, বিচার দেবার আগে জেনে নাও প্রশ্ন করো তুমি কোন্ দল!
ছবি: লেখক

অনিল আচার্য  লেখক, সম্পাদক

কবি শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে আমার পরিচয় আশির দশকে। অবশ্য 'অনুষ্টুপ' পত্রিকা শুরু হয়েছিল ১৯৬৬ সালে। তারপর একটা সময় এল, যখন আমরা এই মানুষটির সংস্পর্শে এলাম। এবং এর ফলে আমরা অনেক বেশি ঋদ্ধ হলাম।

ঋদ্ধ হয়েছিলাম এই অর্থে যে, সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা কেবলমাত্র সমসময়ের বিষয় নয়, তার একটা অতীত আছে, বর্তমান আছে এবং তার একটা ভবিষ্যৎও আছে। শঙ্খবাবু (shankha ghosh) আমাদের কাছে সেই বার্তাই বহন করে এনেছিলেন যে, প্রতিবাদী সত্তার সঙ্গে সহনশীলতা, বিদ্যাচর্চা এবং সমাজবিজ্ঞানকে একসঙ্গে না বুঝলে কোনও পত্রিকা স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে না। 

আর সেই কথাটা কেবল কথার কথা ছিল না। তিনি এক আলোচনায় বলেছিলেন, কবিতার মুহূর্তের কথা। এই 'কবিতার মুহূর্ত' শঙ্খ ঘোষের কবিতার এক ভিন্ন ধরনের সংকলন। যেখানে কবি যখন কবিতা লেখেন, তখন সেই কবিতা লেখার একটা মুহূর্ত সৃষ্টি হয়, যদি তাঁর জীবনের সুখ-দুঃখ-বেদনার অনেক ঘটনা সেখানে সন্নিবেশিত হয়। এই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন-- 'প্রত্যক্ষ ঘটনার সঙ্গে লিপ্ত হয়ে থাকে যে লেখা, তাকে নিয়েই এই এক সঙ্কট। ঘটনা থেকে তার মূল সত্যটা যদি কবিতায় পৌঁছে থাকে, তবে নিছক সেই ঘটনাটুকু জানবার আর কী দরকার?....কবিতার মধ্য দিয়ে তাই পিছনের দিনগুলিতে আরও একবার ফিরে যেতে থাকি, যেতে যেতে দেখি, একটা পথরেখা চিহ্নিত হয়ে আছে'। এই পথরেখার সঙ্কলন হচ্ছে 'কবিতার মুহূর্ত'। 

আরও পড়ুন: 'শঙ্খ ঘোষের কলম একই সঙ্গে আগুন এবং ঝরনাকে নিজের ভিতরে ধারণ করতে পারত', বিনায়ক

যখন বাস্তবিকই আমাদের জীবন কঠিন হয়ে আসে, তখন রাজনৈতিক ইতিহাস মানুষের জীবনে নিয়ে আসে কঠিন সময়। মানুষ তখন দল ছাড়া কিছু চেনে না। এই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন একটি ছোট্ট কাব্যগ্রন্থ 'লাইনেই ছিলাম বাবা'। এই প্রসঙ্গে তার দু'একটি পঙক্তি উল্লেখ করা আবশ্যক। যেমন-- 'বিচার দেবার আগে জেনে নাও দেগে দাও/প্রশ্ন করো তুমি কোন্ দল/আত্মঘাতী ফাঁস থেকে বাসি শব খুলে এনে/কানে কানে প্রশ্ন করো তুমি কোন্ দল/ রাতে ঘুমোবার আগে ভালোবাসবার আগে/প্রশ্ন করো কোন্ দল তুমি কোন্ দল'! এই কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৩ সালে। আজ এই ২০২১ সালেও রাজনৈতিক সমাজের উদ্দেশ্যে কবি কি একই প্রশ্ন তুলে ধরছেন না? এখানেই শঙ্খ ঘোষ তাঁর নিঃশব্দের তর্জনী তুলে ধরেন। পরবর্তী প্রজন্মকে তিনি শেখান, ভয় না পেয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে।

এই প্রসঙ্গে আর একটি কথা বলা দরকার-- শঙ্খ ঘোষের মতো কবি আমাদের বিবেকের কাজ করে থাকেন এবং তখনই মনে হয় সেই কথাটি, 'সেই সত্য যা রচিবে তুমি'। 

শুধু কবিতার ক্ষেত্রেই নয়, ব্যক্তিগত জীবনে মানবিকতার যে অপূর্ব স্পর্শ, তা ব্যক্তিগত ভাবে উপলব্ধি করেছেন তাঁর অসংখ্য  ছাত্র, তাঁর সহকর্মী ও অন্যান্য যাঁরা তাঁর সংস্পর্শে এসেছেন। সেরকম একটি ঘটনার কথা বলি। প্রায় রবীন্দ্রনাথের মতোই অনেক মৃত্যু শঙ্খ ঘোষকে কষ্ট  দিয়েছে, দুঃখ দিয়েছে, কিন্তু তাঁকে ভাঙতে পারেনি। তাঁর ছাত্র কবি জয়দেব বসু যখন অকালপ্রয়াত হলেন তখন শঙ্খ ঘোষ ছুটে গিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় ছাত্র ও প্রিয় কবিকে দেখতে। স্তম্ভিত হয়েছিলেন তিনি। এ মৃত্যু তাঁর কাছে ছিল অসহ্য। বড় আপনজন ছিলেন জয়দেব তাঁর কাছে। কিন্তু তিনি শোকে ভেঙে না পড়ে জয়দেবের কবিতার সঙ্কলন প্রকাশে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে দায়ভার গ্রহণ করলেন। যাতে তাঁর প্রিয় ছাত্র ও কবিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। এরকমই ছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। শুধু নিজের কবিতার কথা তিনি ভাবেননি। কী জয় গোস্বামী (joy goswami), কী জয়দেব বসু বা আর যাঁরা তাঁর পরবর্তী কালে কবিতা লিখে স্বনামধন্য হয়েছেন, তাঁদের কবিতা শুধু নিজে পড়তেন তা-ই নয়, আমাদেরও বলতেন, কোন কবিতাটি কেমন হয়েছে।

এমন মানুষকে কি আমরা আর পাব বা অন্য কোনও কবি (poet) কি আর পাবেন তাঁদের এমন সহযোদ্ধাকে?

আরও পড়ুন: কৃষ্ণগহ্বরের সৃষ্টি হল বাংলা সাহিত্যে, মন খারাপ শীর্ষেন্দুর

                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                        (অনুলিখন)

.