মিউ মিউ শব্দে মাতৃত্ব

Updated By: Feb 10, 2016, 03:59 PM IST
মিউ মিউ শব্দে মাতৃত্ব
ছবি: দেবিকা বিশ্বাস

সৌরভ পাল

একটা মৃতদেহ শেষবার বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছিল সেদিন। সাদা চুল, মুখটায় যেন বট বৃক্ষের মত মূল। চোখগুলো ঘুমন্ত শিশুর মত। যেন এই বুঝি জগতটাকে দেখবে। শরীরটা সরীসৃপের মত ঠাণ্ডা। সেদিনটাও ছিল একটা শীতের রাতের। সবার মনকে উষ্ণ করে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন এক বৃদ্ধা। তিনি কারও 'মা', কারও ঠাকু'মা'। সিঁড়ি থেকে সেদিন কোলে করে ৫ বছরের শিশুর মত নামিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছিল তাঁকে। একটা গাড়ি অপেক্ষা করছিল। কাঠের খাঁচা ছেড়ে লোহার পাটাতনে অনুপ্রবেশ। মৃত্যুপথযাত্রী আর পিছন ফিরে তাকালেন না। হরি নাম বলতে কণ্ঠ কুণ্ঠাবোধ করছিল ওই মুহূর্তটায়। সাহসও হয়নি। একটা কম্পমান কণ্ঠ কানে ধেয়ে ধেয়ে আসছিল। 'যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেন সংস্থিত, নমস্তসই নমস্তসই নমস্তসই নমহ নমহ...' মা হারিয়ে যাওয়া এক মেয়ে, মাকে প্রণাম জানাচ্ছিলেন যতক্ষণ না গাড়িটা বাড়ির উঠোন থেকে শশ্মানের উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছিল। লেখাটা লিখতে বসে দিনটা একেবারেই মনে আসছিল না। দিন মনে করেই বা কী হত? স্বরলিপিই মনে করিয়ে দিল, ৬ জানুয়ারি, ২০১৪

একটা বছর পর। ৭ ফেব্রুয়ারি। নন্দন ৪। এক মেয়ে তাঁর 'মা'কে কাঁধে করে নিয়ে ঘুড়ছেন। বয়স ১ বছরও হয়নি। সেদিন তাঁর কণ্ঠে কোনও ধ্বনি ছিল না, শব্দের মূর্ছনা ছিল পায়ের পায়েলে। নুপুরগুলো ঝন-ঝন করে বাজছিল, আর বারবার বুঝিয়ে দিচ্ছিল অস্তিত্ব। প্রকট হচ্ছিল কিছু কথা, কিছু সুর। 'আমি বহু বাসনায় প্রাণ পণে চাই, বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে...'। জানি না রবীন্দ্রনাথের এ ভাবনা কেন! তবে মিলিয়ে ফেলেছিলাম লাইনগুলোকে ওই মুহূর্তটার সঙ্গে। দুই মা হারা যেন এই ভাবনাতেই বেঁচে উঠল। মায়ের ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েও আবার মায়ের মায়াজালে প্রাণ পণ দিলেন দুই মা হারা।

পুয়ান আর স্বাগতালক্ষী দাশগুপ্ত। কেবল ভারত নয়, ভারতের বাইরেও যার সুরে দেবী সরস্বতীকে খুঁজে পাওয়া যায়, তিনি 'মা' নয় তো কী? 'মা' শব্দ বাদ দিলে এমন কোনও শব্দ পৃথিবীতে আছে নাকি যা মহামায়াকে বর্নণা করে? নেই। ৩৬৫ দিনের একটু বেশি সময় পেরিয়েছে। মাকে হারিয়েছেন। মা হারানোর যন্ত্রণায় যিনি মহমায়ার স্তোত্রকে অবিরাম গেয়ে যেতে পারেন তাঁর হৃদপিণ্ডের উথাল পাতাল সুনামিকেও হার মানায়, এটা কল্প কথা নয়, অনুভব। মা হারিয়ে যাকে পেলেন তিনিও 'মা'। 'কাঁটার আঘাত দাও গো যারে ফুলের আঘাত তাঁর সয়না...' তবে এই ফুল তাঁর উগ্রতাকে স্তিমিত করে এনে দিল প্রেমের রাগ। পুয়ানের প্রতি তিনি গান বার বার, 'তোমারে জানিনে হে, তবু মন তোমাতে ধায়'। শব্দের পিঠে শব্দ চাপিয়ে বাক্যবন্ধনী বানিয়ে যে কথাটা এবার বলতে চলেছি তা বিজ্ঞানের নয়, ভাবনার। একটা ফটো এক্জিবিশন। একথা বলতে দ্বিধা নেই, ছবির নন্দনতত্ত্ব বুঝতে নন্দনে গেলে সেদিন হয়ত হৃদয়শূন্য করেই ফিরতে হত। কিন্তু যদি একবার ভেবে দেখা যায়, পুয়ানের প্রতিটা ছবি, কখনও পুয়ান চায়ের কাপ হাতে, পুয়ান কখনও স্বর্ণালঙ্কারে সেজে উঠছে, পুয়ানের দুটি চোখ দুই রকম, পুয়ান তন্দ্রাচ্ছন্ন আর সব কটা ছবির নীচে নীচে রবীন্দ্রনাথের এক একটা লাইন, বুঝতে হবে অর্থ হলে ফোয়ারা হয়, অশ্রুজল হয় না। এমন তো অনেক শোনা যায়, টাকা থাকলে ভূতের শ্রাদ্ধ হয়, তবে গোলাপ দিবসে ওই ছোট্ট ঘরটায় সেদিন যা চাক্ষুস করলাম তাতে বুঝলাম, 'টাকা থাকে না, থাকে কাজ'। আরও যা যা থাকে তা এভারেস্টের মন। হিমশীতল কঠিন থেকেই তরল গঙ্গোত্রীর সমতলে আগমন আর মোহনায় মিলিয়ে যাওয়া। এটা প্রকৃতি। এটাই কৃষ্টি, এটাই সৃষ্টি। বিধাতা বোধহয় কিছু নিয়ে নেন, কিছু দেওয়ার জন্যই।

পুয়ান একটি বিড়াল ছানা। না বাইরে থেকে কিনে আনা নয়। লক্ষীর ঘরেই পুয়ানকে স্বাগত জানিয়েছিলেন শিল্পী। গৌড়কালির মেয়ে পুয়ান। দেখতে অর্ধেক গৌড়িয়, শ্বেত বর্ণা। আর মাঝে মাঝে কালি বর্ণের কালো কালো ছোপ। আদর করে পুই পুই বললেই কোলে উঠে আসে পুয়ান। ১১ মাসের পুয়ানই এখন স্বাগতালক্ষী দাশগুপ্ত 'মাতৃরূপেণ' মা। খাইয়ে দেন নিজে হাতেই। কখনও কখনও গান করে শোনান। শেষের দিকে মাকেও তো তাই করিয়ে দিতে হত। স্বরলিপির পিসিমণি হলেন স্বাগতালক্ষী দাশগুপ্ত। আর তারও আগে চিনতাম তারকা হিসেবেই। কখনও ভোর দেখেছি তাঁর কণ্ঠে। মন খারাপ হলে তাঁর কণ্ঠের এক একটি শ্লোক যেন আমাকে 'হার না মানা'র বীজ মন্ত্র দিয়ে গিয়েছে প্রতিনিয়ত। সেদিনের ওই চার দেওয়ালের যে দিকেই তাকিয়েছি কেবল পুয়ানময় ছিল। স্বরলিপিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কে এই পুয়ান? বলেছিল, "ঠাম্মা মারা যাওয়ার পর মা বলে সাড়া দেওয়ার কেউ একটা"। আমি মনে মনে অবাকই হয়েছিলাম। আর পর মুহূর্তেই স্বরলিপির আরও এক উত্তরে অবলীলায় মন বুঝে গিয়েছিল, পুয়ান 'মা' ই, 'মা বললে পুয়ান মিউ মিউ করে'।

.