জিম করবেটের পাড়ায়
কূণাল বসু
সেবার উত্তরাখন্ডের পিণ্ডারি গ্লেসিয়ার ট্রেক করে ফেরার পথে হঠাৎ করেই ঠিক হল কাঠগুদাম থেকে ট্রেন ধরার আগে নৈনিতালে একবার ঢুঁ মেরে যাব কয়েকটা ঘণ্টার জন্য। আমাদের গ্রুপ মেম্বাররাও এককথায় রাজি হয়ে গেল। দীর্ঘ পথ হাঁটার পর শরীরটা সত্যিই তখন ক্লান্ত, কিন্তু ভবঘুরে মন তখনও নতুন পথের সন্ধানে। ট্রেক শেষে লোহারক্ষেত থেকেই গাড়ি নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এর পর গাড়ি বাগেশ্বর, বিনসর হয়ে আমাদের নামিয়ে দিল আলমোড়াতে। ব্যস্ত আলমোড়ায় তখন সন্ধ্যা নামছে। শহরটার পেছনে অস্ত যাচ্ছে সূর্যিমামা। বিবেকানন্দ-র অনেক লেখাতে তাঁর প্রিয় আলমোড়া-র কথা পড়েছি। কেন স্বামীজী বারে বারে এখানে এসেছিলেন তা না দেখলে বলে বোঝানো কঠিন। যদিও আজকাল শহরটা জনসংখ্যার চাপে যথেষ্ট ঘিঞ্জি। আলমোড়া থেকে এবার নৈনিতাল যাওয়ার পালা। গাড়ির ব্যবস্থা করা হল। পৌঁছতে পৌঁছতে যে অনেক রাত হবে সেটা বুঝতে পারছিলাম।
গত এক সপ্তাহে কুমায়ুনের যে নির্জন পাহাড়ি পথ, নদি-জল-জঙ্গল পার করেছি, প্রকৃতিকে এত কাছ থেকে উপলব্ধি করেছি সেখানে ভিড়ে ঠাসা নৈনিতাল আদৌ কতটা আমাদের ভালো লাগবে তা নিয়ে সন্দেহে ছিলাম। কিন্তু দুটো বিষয় ছিল যা আকর্ষণটা একবারের জন্যও কমতে দেয়নি। এক, নৈনিতাল নিশ্চয়ই শহর কলকাতা নয়। সেটাও পাহাড়ের গায়েই বেছানো একটা শহর। আর দ্বিতীয় বিষয়টি হল নৈনিতাল মানেই জিম করবেটের পাড়া। হ্যাঁ! সেই কোন ছোটবেলায় নৈনিতালের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ তো জিম করবেটের হাত ধরেই। মহাশ্বেতা দেবীর অনুবাদ করা জিম করবেট অমনিবাসে শিকারের গল্পে কতবারই তো ঘুরে ফিরে আসতো এই শহরটার নাম । করবেটের নিজের শহর। নৈনী লেকের ধারে সবুজে সাজানো সুন্দরী নৈনিতাল। এরপরও পত্র পত্রিকায় কতবার দেখেছি নৈনী লেকে চড়ে বেড়ানো রাজহাঁসের দল ও নৌকাবিহারের ছবি।
চারিদিকে প্রায় অন্ধকার। গাড়ি চলেছে আঁকাবাঁকা পথ ধরে। মাঝে মাঝে অনেক দূরে পাহাড়ের গায়ে বিছানো এক একটা ছোট শহর চোখে পড়ছিল। বেশ কিছুটা পথ চলার পরই ট্রাফিকটা বাড়তে শুরু করল। ব্যস্ত শহরে প্রবেশ করছি বুঝতেই পারছিলাম। কিছুক্ষন পর এই ব্যস্ততাটা বিরক্তিকর হয়ে গেল। মারাত্মক জ্যাম। গাড়ি নড়ছে না। যাই হোক, বেশ কিছুক্ষন কাটার পর অবশেষে গাড়ি আসতে আসতে ওপরে উঠতে শুরু করল। কিছুটা এগোনর পরই গাড়িটা একটা বড় বাঁক নিল। আর বাঁক নেওয়ার পরই যা দেখলাম তা আদৌ লিখে বোঝানো সম্ভব কিনা আমার জানা নেই। তাও আমি চেষ্টা করছি। সামনে বিশাল উঁচু একটা পাহাড়। আর তার গায়ে যেন একটা কার্নিভাল চলছে। লক্ষ লক্ষ আলোর মালায় সাজানো কার্নিভালের রঙ গোলাপি, লাল, হলুদ। গোটা পাহাড়টার গায়ে কেউ যেন বালতি বালতি রঙ ধেলে দিয়েছে। কত উঁচুতে হোটেলের সারি। গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে তাঁরাও যেন কার্নিভালের মজা নিচ্ছে। কেউ কেউ আবার বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে। রাতের অন্ধকার গোটা পাহাড় যেন ঝলমল করছে আলোর ছটায়। এক ঝলকে দেখলে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। মাঝে মাঝে মাথাতেই থাকে না যে এই গোটা কর্মকাণ্ডটা হচ্ছে সমতল থেকে প্রায় সাত হাজার ফুট উঁচুতে
গাড়ি মালপত্র নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমাদের তখনও সেই রুপের ঘোর কাটেনি। বার বার ওপরের দিকে তাকিয়ে তখনও দেখছিলাম। প্রকৃতি ও মানুষের জয়েন্ট ভেঞ্চার, সত্যিই কী অপূর্ব সৃষ্টি। কিন্তু, এরপরেই কপালে যে চরম দুর্ভোগ অপেক্ষা করছিল তখনও টের পাইনি। কিছুক্ষন পরই ঘোর বাস্তবে ফিরে এলাম। এদিক ওদিক ছোটাছুটি চলছে কিন্তু কোনও হোটেলে রুম নেই। ঘড়িতে সাড়ে আটটা বাজে। ঠাণ্ডা হাওয়াটাও বাড়ছে। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে গরম জামাটা গায়ে চাপিয়ে নিয়ে দুটো দলে ভাগ হয়ে বেরিয়ে পরলাম অভিযানে, করবেটের পাড়ায় হোটেলেরের সন্ধানে। যেখানেই গিয়ে উঠছি সেখানেই একটা কথা ‘রুম নেহি হ্যাঁয়’। বোঝো ঠ্যালা !! এখানে হোটেলের অভাব নেই কিন্তু দিল্লি খুব কাছে হওয়ায় নৈনিতালে বারো মাসই সিজেন। আর এই জুন মাসেও তাই গোটা নৈনিতাল ‘প্যাকড আপ’। এই হোটেল থেকে ওই হোটেল চলল ছোটাছুটি, কোথাও কোথাও তো আবার খাওয়াদাওয়া সেরে প্রবেশ দ্বার বন্ধের তোরজোড়ও চলছে। যেন মুখের ওপরই দরজা বন্ধ করে দিল। পাশের এক চাচার কাছ থেকে জানা গেল জনৈক এক ‘আন্টি’র কথা, তাঁর হোটেলে গেলে নাকি রুম পেলেও পাওয়া যেতে পারে। শুরু হল আন্টির খোঁজ। অনেক খোঁজার পর তাঁর সন্ধান মিলল। মিষ্টি স্বভাবের আন্টি, একগাল হেসে বলল,
'রুম???...,' কাল সুভে আও, মিল জায়েগা, আভি তো খালি নেহি হ্যাঁয়’’। ভাবছিলাম আন্টিকে কিছু একটা কড়া জবাব দিই , কিন্তু মুখের ভাষা খরচ করার মত শরীরে তখন আর জোর ছিলনা। পেটে তখন কয়েকশ বেশ বড় মাপের ছুঁচো ডন মেরে মেরে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, এমন সময় সৌরভের ফোনটা এলো, ‘এদিকটায় চলে আয় ভাই, দুটো রুম পেয়েছি’। একটা নয়, আবার দুটো, বোঝো কাণ্ড!! কাঁপতে কাঁপতে বাজেট ছাড়ানো রুমটায় গিয়ে ঢুকলাম। দরজাটা বন্ধ করতে যাব, এমন সময় চোখ পড়ল সেই কার্নিভালের আকাশে। চোখ বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে গেল। এখন রাত প্রায় ১০টা বাজে। আলোগুলো অনেকটাই নিভে গেছে। নাহ, এবার ঘুমোতে যেতে হবে, এখন শুধু কাল সকালটা হওয়ার অপেক্ষা।
সকালটা ছিল অদ্ভুদ মায়াময়। হোটেলের ব্যালকনি দিয়ে দেখা যাচ্ছে ব্যস্ত শহরটাকে। চারিদিকে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ। রাতের সেই আলগুলো যেন এখন নিদ্রা গেছে। ঠাণ্ডাটা একটু কম। ঘন জনবসতি থাকার কারনে এই প্রান্তটা সামান্য ঘিঞ্জি। সকাল সকালই একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। মেঘেদের ব্যস্ততা এখনও যদিও কমেনি। অনেক দূরে পাহাড়ের গা ঘেঁষে সরু রাস্তা দেখা যাচ্ছে। একে একে স্নান সেরে নিলাম আমরা সবাই। নয় দিন পর স্নান করার পর এবার লোকজনের পাশে দাঁড়ানোর কনফিডেন্সটা অন্তত পাওয়া যাবে। অবশেষে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়লাম করবেট সাহেবের পাড়ায়।
কুমায়ুনের এই নৈনি হ্রদের শহরেই জন্ম নীল চোখের সেই আইরিশ শিকারির। ১৯৪৭ সালে ভারত ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে কেনিয়া চলে যান করবেট। তার আগে পর্যন্ত এই শহরেই থাকতেন। তাঁর বাড়িটি আজও আছে এখানে। মিসেস কলাবতী ভার্মাকে বাড়িটি বিক্রি করেছিলেন করবেট। যেটিকে পরবর্তীতে জাদুঘরে রুপান্তরিত করা হয় এবং এর নামকরণ করা হয় 'জিম করবেট জাদুঘর'। হাতে সময় কম থাকায় সেদিকটায় আর যাওয়া হয়নি। সুন্দর সাজানো গোছানো, চারিদিক একেবারে পরিপাটি, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন একটা ক্যানভাস। বিশাল লেককে কেন্দ্র করে পাহাড়বেষ্টিত নৈনিতাল শহর। লেকের ধার ঘেঁসে গাছের সারি ও সুন্দর সাজানো-গোছানো ছায়া মাখানো কালো পিচের একটা রাস্তা( ম্যাল রোড যাকে বলে), রাস্তার ধারে আবার পসরা সাজিয়ে বসে আছে দোকানিরা। পাহাড়ি শহরের দৈনন্দিন ব্যস্ততাটা যেন ধীরে ধীরে বাড়ছে। দূর থেকে ভেসে আসছে নয়না দেবীর মন্দিরের ঘণ্টার আওয়াজ। হাল্কা ঠাণ্ডার পরশ মাখানো বেশ জমজমাট এলাকা হিল স্টেশন। শহরটার আনাচে কানাচে আজও অতীতের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ছাপ রয়ে গেছে। সারা বছরই এখানে কমবেশি পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। লেক জুড়েও তখন নানা রঙের বোট। ওপর থেকে ভারি সুন্দর লাগছে। এখানে এলে বোটিং না করলেই নয়। তাই একঘণ্টার জন্য ভাড়া করা হল একটা হংসরাজ প্যাডেল বোট। হ্রদের মাঝে পৌঁছে গোটা শহরটাকে আবার অন্যরকম লাগে। দূরে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের গায়ে লেগে রয়েছে পেঁজা তুলোর মত মেঘেদের দল। তাদের গা ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে একটা লাল রঙের রোপওয়ে। পাহাড়ের গায়ে বেছানো শহরটা। ঘন গাছপালার মাঝে মাঝে রঙবেরঙের ঘরবাড়ি। এক কথায় অপূর্ব।
পুরাণে এই লেককে ত্রিঋষির হ্রদ নামে বর্ণনা করা হয়েছে। অত্রি, পুলস্থ, পুলহ। এই তিন সাধু নৈনিতালে জল না পেয়ে এক বিশাল গহ্বর খুঁড়ে ফেলেন, এবং তিব্বতের পবিত্র মানস সরোবর থেকে জল নিয়ে আসেন তাঁরা। সেটাই বর্তমানে এই বিশাল নৈনিতাল হ্রদ। বলা হয় সতীর ৬৪ পীঠের মধ্যে নৈনিতাল অন্যতম। মহাদেব যখন সতী অর্থাৎ দেবী পার্বতীর দেহাংশ নিয়ে যাচ্ছিলেন সেসময় সতীর একটি চোখ এখানে পড়েছিল। সেখান থেকেই নাম নৈনিতাল। অর্থাৎ নয়না থেকে নৈনি। যে স্থানে সতীর সেই চোখ পড়েছিল সেখানে একটা মন্দির রয়েছে, নয়না দেবীর মন্দির। এই সব কিছু নিয়েই নৈনিতাল অনবদ্য।
বেলা শেষ হওয়ার পথে। আমাদের নৌকা বিহার শেষে হাল্কা একটু কেনাকাটি সারলাম। এদিকে ট্রেনের সময় হয়ে আসছে। গাড়ি করে অনেকটা পথ যেতে হবে। লাঞ্চ করবো এরই মাঝে হঠাৎ করেই শহরটাকে ভিজিয়ে দিয়ে গেল টানা এক ঘণ্টার একটা বৃষ্টি। বৃষ্টির পর সেই সোঁদা গন্ধটা মনটাকে বড্ড টানছিল। মেঘলা বিকেলটা যেন বার বার বলছিল আজকের রাতটা অন্তত থেকে যেতে। সেই কার্নিভালের রাত যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সুন্দরী নৈনিতালকে এবারের মত বিদায় জানাতেই হবে। হোটেলের বিল মেটানোর পর গাড়ি চলে এল। একটা বড় পাহাড়ের আড়াল হয়ে গাড়িটা নীচের দিকে নামতে থাকে। ক্ষণিকের জন্য কোথায় যেন হারিয়ে যায় শহরটা। কিছুটা পথ চলার পর আমরা অনেক নীচে নেমে এসেছি, একটা বাঁক ঘুরতেই পেছনের দিকে তাকাতে বলল সৌরভ। সন্ধ্যার হাল্কা আলোয় তাকিয়ে দেখলাম দূর পাহাড়ের গায়ে সেই নৈনিতাল। একটা একটা করে আলো জ্বলে উঠছে শহরটার গায়ে। আজ রাতের কার্নিভালের প্রস্তুতি যেন সাড়া। দূরের সেই ইশারা কিছুক্ষণের মধ্যেই হারিয়ে গেল পাহাড়গুলোর আড়ালে।