#ভ্রমণ: হাত বাড়ালেই আদিম অরণ্যের অন্ধকার
হাতের কাছেই পড়ে থাকা লালমাটির এই জঙ্গল-মহল রূপ ও রসের এক আশ্চর্য খনি!
সৌমিত্র সেন
পাহাড়। অরণ্য। বনঝর্না। রোদ্দুর আর জ্যোৎস্না, আকাশ আর বাতাস, শাল আর মহুলের মৌতাতে মহেশ্বর এক খণ্ড নিবিড় বনভূমি।
এই 'ডেডলি কম্বিনেশন' পেতে আপনাকে কিন্তু মোটেই পাড়ি দিতে হবে না অনেক দূরের কোনও দিকশূন্যপুরে। এ একেবারে আমাদের সকলের হাতের কাছেই, আমাদের জন্যই শান্ত অপেক্ষায় জেগে আছে, আমাদের সকলের অতি চেনা-- ঝাড়গ্রাম জেলার কাঁকড়াঝোর।
আরও পড়ুন: Durga Pujo 2022: মহালয়া থেকে দশমী, একনজরে আগামী বছরের দুর্গাপুজোর নির্ঘন্ট
'কাঁকড়া' শব্দের অর্থ 'পাহাড়'। 'ঝোর' শব্দের অর্থ 'অরণ্য'। ঝাড়খণ্ড-ঘেঁষা এই পাহাড়ি-জঙ্গুলে গ্রামের পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে সারি সারি পাহাড়। দক্ষিণ-পুবে মারো পাহাড়, দক্ষিণ-পশ্চিমে খচলা পাহাড় আর পশ্চিমে চোখজুড়োনো লাখাইসিনি। চারিদিকে সঘন গহন শালজঙ্গল। পিয়াশাল, মহুয়া, পলাশ, আকাশমনি, কেঁদ, নিম, হরিতকী, বহেড়ার ভিড়। বন্যপশু বলতে হরিণ, বনশুয়োর, বনময়ূর।
শুধু দুদিন চুপ করে পড়ে থাকা যায় কাঁকড়াঝোরেই। কেউ তা চাইলে এখান থেকে ট্রেক করে যেতে পারেন লাখাইসিনি পাহাড়, আমঝর্না। গাড়ি করে একটু দূরের বেলপাহাড়ি, গালুডিও ঘুরে নেওয়া চলে। রোদ্দুরের তাপে যখন বনভূমিতে ঘন বনজগন্ধ ওঠে, কিংবা জ্যোৎস্নার মলমলের মধ্যে যখন ফুটে ওঠে অরণ্যের দীপ্ত আদিমতা-- এই লালমাটির দেশে সে এক আশ্চর্য মদিরতা জন্ম নেয় তখন।
বিদ্যুৎ খুব সহজলভ্য নয়, তবে এখন সোলার আলোর রমরমা। আগে কুয়োর জলনির্ভর ছিল দৈনন্দিন জীবন, এখন সরকারি জলধারা ঢুকে পড়েছে গ্রামে। আগের চেয়ে পথঘাট ভালো হয়েছে, গাছপালাও এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে কিঞ্চিৎ কমেছে। উন্নয়ন এসেছে। তবুও কাঁকড়াঝোর আজও যা নিয়ে জেগে আছে পর্যটকদের জন্য, তা অমূল্য, অপরিমিত, অদ্ভুত। উন্নয়নের নিভৃতেই এক অনন্য আদিমতা।
কী ভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে ট্রেনে ঝাড়গ্রাম। সড়কপথে এনএইচ সিক্স ধরে খড়্গপুর হয়ে কাঁকড়াঝোর যাওয়া চলে। ঝাড়গ্রাম থেকে প্রায় থেকে প্রায় ৩৮ কিমি বেলপাহাড়ি। ওখান থেকে ওদোলচুয়া হয়ে চড়াই-উতরাই মোরামপথ ধরে ২২ কিলোমিটার কাঁকড়াঝোর। অন্য ভাবেও আসা চলে। প্রথমে ট্রেনে ঘাটশিলা। ওখান থেকে গাড়ি নিয়ে কাঁকড়াঝোর। দূরত্ব প্রায় ৩১ কিমি। অ্যাডভেঞ্চার-প্রেমীরা ট্রেক করেও কাঁকড়াঝোর পৌঁছতে পারেন। এ পথে গাইড নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে। বেলপাহাড়ি পেরিয়ে ভুলাভেদা থেকে সতেরো কিলোমিটার জঙ্গলপথ ট্রেক করে কাঁকড়াঝোর যাওয়াটা একটা লাইফটাইম এক্সপিরিয়েন্স হতে পারে। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ভুলাভেদা থেকে কাঁকড়াঝোর যাওয়ার পাহাড়ি পাথুরে লালমাটির রাস্তাটির নৈসর্গিক দৃশ্য অপরূপ। দীর্ঘদিন ধরে মাওবাদী কার্যকলাপের জেরে রাস্তাটি বন্ধ ছিল। তবে এখন বছরচারেক হল এ পথ ফের পর্যটকদের কাছে আদরণীয় হয়ে উঠছে।
কোথায় থাকবেন
কাঁকড়াঝোরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি হল গোপী মাহাতোর লজ। এই গোপী মাহাতো কাঁকড়াঝোরের এক বিশেষ চরিত্র। এখন তিনি প্রয়াত। কিন্তু তাঁর লজ আজও তাঁর ঐতিহ্য ও স্মৃতি বহন করছে। আজও মানুষ কাঁকড়াঝোর গেলে গোপী মাহাতোর লজের খোঁজ করেন।
তবে এখন সেখানে বেশ কয়েকটি হোম স্টে তৈরি হয়েছে। হয়েছে এক নতুন গেস্ট হাউসও। হোম স্টে'র খরচ সাধ্যের মধ্যেই। তবে গেস্ট হাউসের খরচ কিঞ্চিৎ বেশি। যদিও সেখানে পরিষেবার মানও উন্নত।
বহু নতুন নতুন স্পট মানুষ এখন নিয়ত এক্সপ্লোর করছেন। কিন্তু কাঁকড়াঝোরের মহিমা অক্ষুণ্ণই। কাঁকড়াঝোরে জ্যোৎস্নারাত্রে যখন দূর থেকে ধামসা-মাদলের শব্দ ভেসে আসবে, যখন নৈশনৈঃশব্দের পরত ছিঁড়ে সেখানে শোনা যাবে নানা আরণ্যক শব্দ, যখন পাথরের মতো কঠিন স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ আকাশে উঁকি দেবে নক্ষত্রখচিত এক অন্যতর আকাশ--তখন আপনার মনে না-হয়ে পারবে না যে, বেড়ানোর জন্য হাতের কাছেই পড়ে থাকা এই লালমাটির জঙ্গল-মহল রূপ ও রসের এক আশ্চর্য খনি। যে খনির টানে সেখানে বারবার ছুটে যেতে ইচ্ছে হবে।
(Zee 24 Ghanta App : দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)
আরও পড়ুন: #ভ্রমণ: ছুটিতে যেতে চান নির্জন সৈকতে? চলুন লাল কাঁকড়ার দেশে