'বহুত বড়িয়া! বসাকজি, আপ তো কলাকার হ্যায়' নরেন্দ্র মোদী
রামায়ণ, মহাভারত এবং বাংলার লোকসংস্কৃতির নানা উপাদান শাড়ির বুননে মিশিয়েছেন তিনি।
নিজস্ব প্রতিবেদন: একটা উত্তরণ। একটা মুহূর্ত। একটা ইতিহাসও।
যে উত্তরণ বলছে, একদা প্রাণভয়ে দেশছাড়া হয়েছিল যে ছেলেটি প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে তিনি নানাবিধ পুরস্কারে সজ্জিত, দ্যোতিত, ললিত, অভিনন্দিত এক মানুষ!
যে মুহূর্ত বলছে, একদা সারাদিন খেটে শাড়ি বুনে সামান্য আয়ে কোনওরকমে পেট চালাত যে পরিবার, সেই পরিবারের এক অকিঞ্চিৎকর সন্তান আজ দেশের প্রধানমন্ত্রীর মুখোমুখি দাঁড়ানো এক 'কলাকার'; স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যাঁর প্রশংসা করে ফেসবুক পোস্ট করেন।
আরও পড়ুন: অর্পিতার জায়গায় লুইজিনহো! এবার গোয়া থেকে রাজ্যসভায় তৃণমূল
আর ইতিহাস তো বটেই! একটা অ্যাচিভমেন্টের ইতিহাস। অর্জনের কাহিনি। যে-কাহিনিতে একদা কপর্দকশূন্য এক বালকের গলার সোনার হার বেচে তার এবং তার দুর্দশাগ্রস্ত পরিবারের গ্রাসাচ্ছাদন জোগাড় করতে হয়েছিল, তাঁরই অধীনে আজ কাজ করছেন কয়েকহাজার তাঁতশিল্পী!
তিনি স্বনামধন্য বীরেনকুমার বসাক। বিশিষ্ট তাঁতশিল্পী। এবারের পদ্মশ্রী প্রাপক। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দিয়েছেন তাঁর শিল্পের নমুনা। যা দেখে উচ্ছ্বসিত মোদী। প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন বীরেনকুমারকে। উপহার পেয়ে উপহারের এবং 'শিল্পী' বীরেনের প্রভূত প্রশংসা করেন তিনি। তাঁকে বলেন-- 'আপ তো কলাকার হ্যায়'! পরে ফেসবুকেও পদ্মশ্রী এই তাঁতশিল্পীর প্রশংসা করেন নরেন্দ্র মোদী। একদা 'বিখ্যাত' বীরেনকুমার তাই মোদী-স্পর্শে যেন 'বিখ্যাততর' হয়ে উঠেছেন।
কী লিখেছেন প্রধানমন্ত্রী সেখানে?
মোদী লিখছেন-- 'শ্রী বীরেনকুমার বসাক পশ্চিমবঙ্গের নদিয়ার অন্তর্গত স্বনামধন্য এক তাঁতী, যিনি তাঁর শাড়িতে ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। পদ্ম পুরস্কার প্রাপকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি আমার কাছে এমন কিছু উপস্থাপন করেন যা আমার খুবই পছন্দ হয়।'
তাঁতশিল্পী?
এখন আর বীরেনকুমারকে হয়তো শুধুই তাঁতশিল্পী বলা যায় না। কেননা, তিনি এখন এক পরিচিত কীর্তনীয়াও। তবে বংশপরম্পরায় তাঁরা তাঁতীই। বাবাও ছিলেন তাঁতী। তবে তিনি তাঁর সময়ে তাঁর এলাকায় ছিলেন বিখ্যাত এক লোককবিও। ১৯৫০ সাল নাগাদ পালাগান করে তিনি একরাতে ১০ টাকাও রোজগার করতেন, যখন একজোড়া শাড়ি বুনে রোজগার ছিল ২টাকা! এহেন বাবার সন্তান বীরেনকুমারও ঘটনাচক্রে বাবার 'লিনিয়েজ'ই বহন করছেন। তিনিও এখন অষ্টম প্রহরের কীর্তনগান করে বেড়ান। বয়সের কারণে নিজে আর তাঁত বোনার পরিশ্রম করতে পারেন না। তবে তাঁর ওয়ার্কশপে এখন কাজ করছেন প্রায় ৫০০০ কর্মী। তাঁরা সেখানে মন্দ রোজগার করেন না।
পূর্ব পাকিস্তানের (অধুনা বাংলাদেশ) টাঙ্গাইলে জন্ম বীরেনকুমারের। ১৯৫১ সালে। ১৯৫৮ সাল নাগাদ নানা কারণে অশান্ত হয়ে ওঠে ওই এলাকা। অবশেষে ১৯৬২ সালে ভিটেমাটি ছেড়ে কপর্দকশূন্য অবস্থায় নদিয়ার ফুলিয়ায় চলে আসতে বাধ্য হয় তাঁর পরিবার। এখানেই বেড়ে ওঠা, তাঁতের কাজ শেখা, রোজগারের চেষ্টায় কলকাতায় যাওয়া, সেখানেও নানা নতুন নতুন লড়াই, অবশেষে পায়ের তলায় একটু জমি পাওয়া, একটু সুদিনের মুখ দেখতে পাওয়া।
কিন্তু তাঁর শিল্পীসত্তা তাঁকে শুধু পেটচালানোর তৃপ্তিটুকুর মধ্যেই বেঁধে রাখেনি। তিনি পথ ভেঙেছেন। তিনি আরও দূরে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছেন। তিনি ধীরে ধারে সাদামাঠা তাঁতের কাজে নিয়ে এসেছেন শৈল্পিক ভাবনা। সমৃদ্ধ করেছেন শাড়ির কারুকৃৎকে। টাঙ্গাইল শাড়ির সাধারণ জমিতে বুনে দিয়েছেন সংস্কৃতির নানা রূপকল্প। রামায়ণ, মহাভারত এবং বাংলার লোকসংস্কৃতির নানা উপাদান শাড়ির বুননে মিশিয়ে দেন তিনি। পাশাপাশি শাড়ি বোনার টেকনিক্যাল দিকেও 'রিভাইভ্যাল' আনেন। চলতি ৮০-১০০ কাউন্টের সুতোর শাড়ির পাশাপাশি তিনি ৫০০ কাউন্টের সুতো নিয়েও কাজ করার দুঃসাহস দেখান, সফলও হন।
এহেন তাঁতশিল্পী, কীর্তনশিল্পী বীরেনকুমার যখন প্রধানমন্ত্রীর মুখোমুখি দাঁড়ান, কী মনে হয় তাঁর?
আদ্যন্ত আপ্লুত বীরেনকুমার বলেন, 'আনন্দ তো মুখে প্রকাশ করা যায় না! কী বলব! মোদীজির জন্য একটা শাড়ি বুনেছিলাম সেই ২০১২ সালে। কিন্তু তাঁর কাছে পৌঁছতে পারিনি। এখন যখন সুযোগ এল আনন্দে তৃপ্তিতে কথা হারালাম। প্রধানমন্ত্রী যখন আমার দিকে তাকিয়েছিলেন সেই সময়টুকু আমি যেন আর আমার মধ্যে ছিলাম না! তিনি বললেন, বসাকজি, আপ তো কলাকার হ্যায়! আমি শুধু বলতে পারলাম, এটা আপনাকে দেব বলে এতদিন বসেছিলাম, আজ আপনার হাতে তুলে দিতে পারলাম।'
(Zee 24 Ghanta App: দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)
আরও পড়ুন: টেনিস কোর্ট থেকে মাছের বাজার, নতুন রূপে লিয়েন্ডার পেজ