শুধু বিদ্রোহী নন, বরং প্রেম ও সুন্দরের সার্থক সাধক নজরুল

কবিপক্ষের শেষ এই নজরুলজয়ন্তী। ১১ জ্যৈষ্ঠ। নজরুল ইসলামের জন্মদিন।

Updated By: May 26, 2021, 03:45 PM IST
শুধু বিদ্রোহী নন, বরং প্রেম ও সুন্দরের সার্থক সাধক নজরুল

সৌমিত্র সেন

নজরুলের নানা পরিচয়। কিন্তু সব পরিচয় ঢেকে তাঁকে আমরা দাগিয়ে দিয়েছি 'বিদ্রোহী কবি' হিসেবে। বিদ্রোহী তিনি বটেই। এজন্য নয় যে, ওই নামেই তাঁর বহুবিখ্যাত-বহুচর্চিত দীর্ঘ কবিতাটি রয়েছে। তিনি 'বিদ্রোহী' অন্য অনেক কারণেও। যুগোত্তরের সাধনা না করে যুগের যে-চর্চায় তিনি নিজেকে নিঃশেষে দান করেছিলেন, তার তুলনা কমই আছে। কিন্তু অমিত প্রতিভার অধিকারী ছিলেন বলেই তিনি হুজুগের কবি হয়েও নিজের যুগ ছাড়িয়ে আমাদের কালে এসেও ছায়া ফেলেছেন।

মূলত-কবি নজরুল ইসলাম তাঁর বিপুল কাব্যে সাম্যবাদের ধুন তুলেছেন। তাঁর কাব্যে রয়েছে শ্রেণিচেতনা, মানবতা, নিপীড়িতের প্রতি সহমর্মিতা, রয়েছে স্থানিক ও সাময়িক রাজনৈতিকতার সঙ্গে আন্তর্জাতিকতার মিশেলও। তিনি 'মজদুর স্বরাজ পার্টি'র 'লাঙল' পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন, পরে 'ধূমকেতু'। স্বদেশি গান-কবিতা লিখেছেন, জেল খেটেছেন। কিন্তু এই বহুবিচিত্রকর্মা কবিটির ফুটন্ত অন্তরে একটা মর্মরিত বাঁশিও ছিল। সে-বাঁশিতে বাজত সুন্দর ও প্রেমের সুর। 

আরও পড়ুন: শুরু করেছিলেন শরৎচন্দ্র, ১৫০ বছর পরেও বলতে হচ্ছে, 'বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও'

যিনি তাঁর বিদ্রোহী-তকমা সৃষ্টিকারী কবিতাতেই এমন চরণ লেখেন-- 'আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেণী, তন্বী নয়নে বহ্নি/আমি ষোড়শীর হৃদি সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি', তাঁর চিত্ততলে যে প্রেম ও সুন্দরের ধ্যানপ্রবাহ ফল্গুর মতোই নিহিত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। 

'অনামিকা' কবিতায় তিনি লিখছেন-- 'আমারি প্রেমের মাঝে রয়েছে গোপন/বৃথা আমি খুঁজে মরি জন্মে জন্মে করিনু রোদন'। যে-কোনও আত্মমগ্ন আত্মসংবেদী গীতিকবির মতোই নজরুলের কাব্যেও আত্মের উদযাপন আছে, তবে তা একটু আলাদা ধাঁচে ও ধরনে। ওয়াল্ট হুইটম্যান যেমন তাঁর 'Song of Myself' শুরুই করেছিলেন 'I celebrate myself and sing myself' দিয়ে, তেমনই কি নজরুল-কবিতায় শোনা যায়নি এমন উল্লাস-- 'আমি সহসা আমারে চিনিয়া ফেলেছি আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ'?

দেখতে গেলে অবশ্য কবিতায় নয়, গানেই এই-নজরুলের প্রকাশ বেশি। সঙ্গীতের নজরুল অনেক মেদুর ও মধুর, অনেক নিভৃত ও নিবিড়, অনেক গহন ও তন্ময়। দেহাতীত অসীম অনন্তকে পাশ কাটিয়ে তিনি আমাদের চেনা-দেখা জগতের যে ইন্দ্রিয়-সংবেদ্য রূপকল্প রচনা করেন, যেখানে আমরা জুঁইয়ের পাশেই পাই হাসনুহানাকে, গোলাপবাগের পাশেই পাই দ্রাক্ষাবনকে, হেনার পাশেই পাই শেফালিকে; এবং তাঁর গানের সেই রক্তদীপ্ত উষ্ণ স্নিগ্ধ সংরাগললিত মনোবেদনার আশ্লেষমদিরতাই যেন তাঁর কবিমনটিকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে তুলে রাখে। এবং আমরা আজও বিস্মিত-আপ্লুত হই। 

আরও পড়ুন: শ্রদ্ধাবীজ, জলপাত্র ও এক 'সম্বুদ্ধ' কৃষক'রত্নে'র কাহিনি
    

.