জাতীয় শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে দেশজুড়ে মিছিলে পা মেলাচ্ছেন বামছাত্ররা
পশ্চিমবঙ্গে ১৪ দিন ধরে ২২টি জেলায় ২৫০০ কিলোমিটারের বেশি ভ্রমণ করবে এই দুটি ছাত্র জাঠা। আপাতত দেখা যাচ্ছে, তাদের যাত্রাপথে পশ্চিমবঙ্গে ১৩২টি ছোট বড় সভা ও মিছিল অতিক্রম করবে জাঠা দুটি। এছাড়াও অগণিত কর্মসূচী চলছে এই জাঠাকে ঘিরে।
সৃজন ভট্টাচার্য্য (রাজ্য সম্পাদক, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতের ছাত্র ফেডারেশন)
দেশের ৫ প্রান্ত থেকে, 'মার্চ ফর এডুকেশন' নামে, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় 'শিক্ষার জন্য পদযাত্রা' - সর্বভারতীয় ছাত্র জাঠা পথ হাঁটছে ১ অগস্ট থেকে। আগামী ২০ সেপ্টেম্বর শেষ জাঠার শেষ সমাবেশটি হবে আহমেদাবাদে। আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করছে দুটি জাঠা। ১৯ অগস্ট কোচবিহারের বক্সিরহাটে প্রবেশ করেছে ত্রিপুরা ও অসম হয়ে আসা উত্তর পূর্ব ভারতের জাঠা। ২০ অগস্ট পূর্ব মেদিনীপুরের দীঘায় প্রবেশ করেছে বিহার, ঝাড়খণ্ড ও উড়িষ্যা হয়ে আসা পূর্ব ভারতের জাঠা। পশ্চিমবঙ্গে ১৪ দিন ধরে ২২টি জেলায় ২৫০০ কিলোমিটারের বেশি ভ্রমণ করবে এই দুটি ছাত্র জাঠা। আপাতত দেখা যাচ্ছে, তাদের যাত্রাপথে পশ্চিমবঙ্গে ১৩২টি ছোট বড় সভা ও মিছিল অতিক্রম করবে জাঠা দুটি। এছাড়াও অগণিত কর্মসূচী চলছে এই জাঠাকে ঘিরে। আমরা স্লোগান দিয়েছি - শিক্ষা বাঁচাও, সংবিধান বাঁচাও, দেশ বাঁচাও। চ্যালেঞ্জ নিয়েছি, জাঠার খবর পৌঁছে দেব এক কোটি ছাত্রের কাছে।
দশ দিনের অভিজ্ঞতা
জাঠাকে কেন্দ্র করে সাংগঠনিকভাবে নড়াচড়া হচ্ছে এসএফআই'এর প্রতিটি স্তরে। ইতিমধ্যেই আলিপুরদুয়ারের ফালাকাটায় এবং পুরুলিয়াতে সিধো-কানহো বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃণমূলের সঙ্গে টক্কর নিয়ে এগিয়েছে জাঠা। পূর্ব মেদিনীপুরে খোদ অধিকারী সাম্রাজ্যে আরএসএস-এর চোখে চোখ রেখে পথ হেঁটেছে ছাত্ররা। দুর্গাপুরে পুলিসি ব্যারিকেডে আছড়ে পড়েছে ছাত্র বিক্ষোভ। মুর্শিদাবাদেও পুলিসি বাধা অতিক্রম করেই এগোতে হয়েছে এই জাঠাকে। চা-বাগান থেকে দেউচা পাচামি, বিশ্ববিদ্যালয় গেট থেকে শ্রমিক মহল্লা-জাঠা এগোচ্ছে ছাত্র সমাজের ভালবাসা কুড়োতে কুড়োতেই।
জাতীয় শিক্ষানীতি বাতিল করো
আমাদের পরিষ্কার কথা, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ বাতিল করতে হবে। এই শিক্ষানীতি দরিদ্র মধ্যবিত্ত ছাত্রদের প্রতি সুবিচার করে না। এই শিক্ষানীতি লেখাপড়ার খরচ বাড়ায়, লাগামছাড়া বেসরকারিকরণের বন্দোবস্ত করে এবং অনগ্রসর প্রান্তিক ছাত্রদের শিক্ষার সুযোগ কেড়ে নেয়। এই শিক্ষানীতি 'ভার্টিকল নলেজ' বা গভীরে গিয়ে কোনও বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের সুযোগকে সঙ্কুচিত করে দেয়। শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য যে আগামী প্রজন্মের মনে মুক্ত চিন্তার পরিসর প্রস্তুত করা, সে কথা অস্বীকার করে শারীরিক কর্মদক্ষতাকে বৌদ্ধিক বিকাশের থেকে আলাদা করে ভবিষ্যতের প্রতিনিধিদের সস্তার শ্রমিক বানাতে চায় এই শিক্ষানীতি। এমন সর্বনাশা জাতীয় শিক্ষানীতি, যাতে একটিবারের জন্যও ধর্মনিরপেক্ষতা ও বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যকে কে উদযাপন করার কথা বলা নেই। চোর-ডাকাত-দাঙ্গাবাজদের হাতে তৈরি শিক্ষানীতি মানবো না। এই বার্তা দৃঢ়ভাবে সামনে এনেই জাঠা বলছে, খোঁজ করো বিকল্পের।
বিকল্প শিক্ষানীতির প্রস্তাব
একমাত্র ছাত্র সংগঠন হিসেবে, বিকল্প শিক্ষানীতি গঠনের কাজে হাত লাগিয়েছি আমরা। যে শিক্ষানীতিতে লকডাউনে ডিজিটাল ডিভাইডের শিকার হওয়া দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার মূলস্রোতে ফেরানোর উদ্দেশ্য নিয়ে গঠন হবে স্পেশ্যাল প্যাকেজ। যে শিক্ষানীতি সরকারি ব্যয়বরাদ্দ বাড়াতে বলবে শিক্ষাখাতে, মিড ডে মিল থেকে গবেষকদের স্কলারশিপ-ফেলোশিপ, প্রতিটি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের তরফে দেখভালের পরিসর বাড়ানোর দাবি করবে যে শিক্ষানীতি। যে শিক্ষানীতি স্বচ্ছ শিক্ষক নিয়োগের বন্দোবস্ত করবে, যাতে আর কোথাও কোনো পার্থ চ্যাটার্জি আগামীর প্রজন্মকে ঠকিয়ে ফ্ল্যাটে টাকা জমাতে না পারেন। আমরা হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের বিপ্রতীপে গিয়ে বলব বিবিধের মাঝে মহান মিলনের কথা। আমাদের বিকল্প শিক্ষানীতি, প্রতিষ্ঠিত করবে আম্বেদকরের হাতে তৈরি সংবিধানের মূল্যবোধকেই। আগামী ২ সেপ্টেম্বর দিনের আলো দেখবে বিকল্প শিক্ষানীতির খসড়া।
স্বাধীনতা ৭৫ ও বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে স্মরণ
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কাজ রয়েছে এই জাঠার। আমরা স্বাধীনতার ৭৫ বছরে আরেকবার মনে করাতে চাইছি সংবিধানের মূলমন্ত্রগুলিকে। ছাত্র জাঠা স্মরণ করতে করতে এগোচ্ছে আমাদের দেশজ মনীষীদের, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের, প্রগতির লড়াইয়ের শহীদদের। ক্ষুদিরাম, ভগৎ সিং, সুভাষচন্দ্র বসুরা তো বটেই, জাঠা স্মরণ করছে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, বিদ্যাসাগর, পঞ্চানন বর্মা, ভানুভক্ত, রঘুনাথ মুর্মু বা হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুরের মতো বাংলার সমাজজীবনে দীর্ঘমেয়াদী ছাপ রেখে যাওয়া ব্যক্তিত্বদেরও৷ আমাদের বোঝাপড়া পরিষ্কার। এই বিপুল বৈচিত্র্যের ঠাসবুনোটে গড়ে ওঠা মানবতার মহাসাগরকে, আমাদের মিলেমিশে বাঁচার ইতিহাসকে উদযাপন করতেই হবে আরএসএস-বিজেপি'র সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে প্রতিহত করতে গেলে। ওরা যত একমাত্রিক সমাজের কথা বলবে, আমরা তুলে ধরব সহিষ্ণু বহুমাত্রিক বিবিধতায় ভরা বাংলার ইতিহাসকে। ওদের সঙ্গে সাভারকর থাকলে আমাদের সঙ্গে আছেন চৈতন্য আর লালন ফকির। নবজীবনের গান গেয়ে, সুকান্ত'র লাইন ধার করে বলেছি আমরা - এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে। আরএসএস স্বাধীনতা আন্দোলনে কোথাও ছিল না, এ কথা নতুন করে মনে করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তো আঠারোরই এখন।
আরও পড়ুন: Madan Mitra: দলের নির্দেশ! মিডিয়াকে 'বয়কট' করলেন মদন মিত্র
২ সেপ্টেম্বর সমাবেশ। হাজারো ছাত্রছাত্রীকে সামিল করে দুটি ছাত্রজাঠা এসে মিলবে ১৫তম দিনে। ২ সেপ্টেম্বর বেলা ১২টায় কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে। সাম্প্রতিককালের বৃহত্তম ছাত্র সমাবেশটির মঞ্চ থেকে আমরা জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ বাতিল করার দাবির পাশেই ঘোষণা করব বিকল্প শিক্ষানীতির খসড়া। ছাত্র আন্দোলনের কর্মীদের সঙ্গেই প্রধান বক্তা হিসাবে উপস্থিত থাকবেন আমাদের সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক বিমান বসু। ছাত্র শহীদদের স্মরণ করে, আগামীর আন্দোলনের শপথ বুকে, রাস্তার লড়াইকে ক্যাম্পাসে পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকার করেই সমাপ্ত হবে ছাত্র জাঠা। দাঙ্গাবাজের হাত থেকে, চাকরি-চোরের হাত থেকে বাংলার তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করার সংগ্রামে গতি বাড়বে কেবল আগামীদিনে, কমবে না।
(*এই কলামটির মতামত লেখকের নিজস্ব। তার দায়ও লেখকেরই)