অস্কার পাক রিচার্ড পার্কার
ছবিটা কেমন এটা লেখা বেশ কঠিন। অনেকটা জুঁই ফুলের গন্ধ নিয়ে রিভিউ লেখার মতো। ভাল। জানি। কিন্তু ভালর কার্যকারণ ব্যাখ্যা করাই মুশকিল। ইয়ান মারটলের `লাইফ অফ পাই` একেবারেই অসেলুলয়েডীয় উপন্যাস। সিনেমাটা দেখে একটা রোখ চেপেছে। হঠাৎ-সুযোগ-ঘটে-যাওয়া কোনও সাক্ষাৎকারে জানতে চাইব হাল্ক, সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি, ব্রোকব্যাক মাউন্টেনের কবি অ্যাং লি থেকে লাইফ অফ পাই-এর চিত্রশিল্পী অ্যাং লিতে উত্তরণের গল্প।
শময়িতা চক্রবর্তী
রেটিং- *****
ছবিটা কেমন এটা লেখা বেশ কঠিন। অনেকটা জুঁই ফুলের গন্ধ নিয়ে রিভিউ লেখার মতো। ভাল। জানি। কিন্তু ভালর কার্যকারণ ব্যাখ্যা করাই মুশকিল। ইয়ান মারটলের `লাইফ অফ পাই` একেবারেই অসেলুলয়েডীয় উপন্যাস। সিনেমাটা দেখে একটা রোখ চেপেছে। হঠাৎ-সুযোগ-ঘটে-যাওয়া কোনও সাক্ষাৎকারে জানতে চাইব হাল্ক, সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি, ব্রোকব্যাক মাউন্টেনের কবি অ্যাং লি থেকে লাইফ অফ পাই-এর চিত্রশিল্পী অ্যাং লিতে উত্তরণের গল্প। ছবির দুই নায়ক, পাই এবং রিচার্ড পার্কারের সাগরযাত্রায় প্যালেট সাজানো ছবি। একটা দৃশ্যর কথা না বললেই নয়। রাতের অন্ধকারে প্যাসিফিক বিস্তৃত উজ্জ্বল বায়োল্যুমিনিসেন্ট বা জৈব দীপ্তির মায়ার চাদর ফুঁড়ে উঠে আসা দানবাকৃতি তিমির ঝামড়। শুধু এই শটটা ব্যাখ্যা করেই দৃশ্যকল্পের একটা সেমিনার হয়ে যায়।
পিসিন মলিটর `পাই` প্যাটেল (টিন-এজে সূরয কাপুর, বড় হয়ে ইরফান খান)। ফরাসি স্যুইমিং পুলের নামানুসারে তার নাম। একটু বড় হতেই নাম নিয়ে বন্ধুদের মস্করা সহ্যের সীমা ছাড়ায়। নিজেই নিজের নাম রাখে পাই। গল্পের প্রথম প্রোটাগনিস্ট। ছোটবেলায় বাড়িতে চিড়িয়াখানা ছিল। বাবার ইচ্ছায় সপরিবারে (চিড়িয়াখানার বেশিরভাগ জন্তু সহ) চেনা শহর, চেনা বান্ধবী ছেড়ে পাড়ি দিল কানাডা। প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে তুমুল ঝড়ে ডুবল জাহাজ। লাইফ বোট সম্বল করে বেঁচে গেল পাই। তবে একা নয়। পাই-এর আর্কে জায়গা পেল প্রাণ বাঁচাতে মরিয়া আরও চার জন পূর্ব পরিচিত। পা ভাঙা জেব্রা, সদ্য শিশুহারা ওরাং ওটাং (নাম অরেঞ্জ জুস), কুতকুতে হায়না আর রিচার্ড পার্কার-তিন বছরের প্রাপ্ত বয়স্ক প্রমাণ সাইজের বেঙ্গল টাইগার। ছবির দ্বিতীয় প্রোটাগনিস্ট। খুব দ্রুত যোগ্যতমের উদ্বর্তন তত্ত্ব মেনে একে একে মিলিয়ে যায় জেব্রা, ওরাং ওটাং, হায়না। দিগন্তবিস্তৃত মহাসাগরের অকিঞ্চিৎকর লাইফ বোটে পড়ে থাকে পাই, রিচার্ড পার্কার আর টিকে থাকার লড়াইয়ের এক অসামান্য প্যারাব্ল। ছবির সিংহভাগ জুড়ে সেই ২২৭ দিন বেঁচে থাকার রূপককাহিনি। বার বার মনে পড়ে যাচ্ছিল হার না মানা, অপরিমিত জীবনীশক্তি নিয়ে স্যান্টিয়াগোর ৮৪ দিনের সমুদ্রযাত্রার গল্প।
দর্শনেন্দ্রিয়ের প্রত্যেকটি স্নায়ুকে উদ্বেল করে দেয় এমন থ্রি ডির দৃশ্যসুখ। অ্যাং লির চোখে আঁকা থ্রি ডি। দর্শকের পিলে চমকে দেওয়ার জন্য নয়, চোখ ভরে সিনেমাটা উপভোগ করার মাধ্যম এই থ্রি ডি। এযাবৎকালের যে কোনও ছবির থ্রি ডি ভার্সনকে পিছনে ফেলে দেবে লাইফ অফ পাই। সুতরাং, একটু বেশি টাকার টিকিট কেটে থ্রি ডি দেখাই ভাল। আদিগন্ত স্বচ্ছ নীল জলের মসলিন আস্তরণের মুক্ত মঞ্চে ভাসমান লাইফ বোটে এক বাঘ আর অস্থায়ী ভেলায় এক কিশোরের অকল্পনীয় সহাবস্থানের থ্রি ডি এফেক্ট রাত ঘুমেও চোখে লেগে থাকে।
অসিনেমীয় গল্প, আনকোরা নায়ক, আর কখনও-আসল-কখনও-কম্প্যুটার গ্রাফিক্স ইমেজের (সিজিআই) এক প্রাপ্ত বয়স্ক বাঘ। `হলিউড-সিনেমা`র পরিচিত হিট ফর্মুলা নয় একেবারেই। সেই হিট ফর্মুলার অনুপস্থিতির প্রতিকূলতা ছাপিয়ে এই ছবির অনন্য হয়ে ওঠার রেসিপি অ্যাং লির পরিচালনার শিল্পদক্ষতায়। নবাগত সূরয শর্মার প্রগাঢ় উপস্থিতি হোক বা বড় হয়ে ওঠা পাইএর ভূমিকায় ইরফান খান। পাইয়ের মায়ের ছোট ভূমিকায় টাবু বা বন্ধ হয়ে যাওয়া লেখনীর পরিশীলিত যন্ত্রণায় লেখক রেফ স্পল। প্রত্যেকটা চরিত্রকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে সিনেমায় বুনে যাওয়ার কাজ করে গিয়েছেন লি।
সব শেষে আসি রিচার্ড পার্কারে। সিজিআইয়ের দোহাই দিয়ে অস্কার দৌড়ে বিবেচিত হবে না রিচার্ড পার্কারের অভিনয়। যেমন হয়নি আগি, ২০১১-র অস্কারজয়ী আর্টিস্ট-এর টেরিয়র, যাকে ছাড়া অসম্পূর্ণ সিনেমার পরিণতি। লাইফ অফ পাই-এ যে তিনবার গলার কাছে কষ্ট কুণ্ডলী পাকিয়েছে, চোখের কোনটা মুছতে বাধ্য হয়েছি তা এই রিচার্ড পার্কারের জন্যই। না, সমুদ্রঝড়ে বাপ-মা মরে যাওয়া নয়। লাগাতার ২২৭ দিনের উদ্বর্তন যন্ত্রণা নয়। মেক্সিকো তীরে মনুষ্যকূলের সান্নিধ্যে এসে পাইয়ের হাউহাউ করে করে কেঁদে ফেলা তো রিচার্ড পার্কারের জন্যই। সব শেষে রিচার্ড পার্কারের অনাড়ম্বর, টাটা-না-বলে চলে যাওয়ার বিচ্ছেদ বেদনাই সিনেমাটা শেষ হতে দিল না। ডুবে যেতে যেতে, খাবি খেতে খেতে বাঁচতে চাওয়ার আকুতি, দিগন্ত জরিপে দার্শনিক হতাশা হলিউডের অ-মনুষ্য অভিনেতা সম্প্রদায়ে রিচার্ড পার্কারকে উচ্চাসন পাকা করে দিয়েছে।
ছবির দুর্বলতা? উপেক্ষণীয়, কিন্তু অনুপস্থিত নয়। সিনেমা করার অনুপযোগী উপন্যাসকে সেলুলয়েডে আনা সহজ ছিল না। সেই কঠিন কাজ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাবলীল ভাষায় লিখেছেন চিত্রনাট্যকার ডেভিড ম্যাগি (ফাইন্ডিং নেভারল্যান্ড)। কিন্তু কোথাও কোথাও গতি ঝিমিয়ে পড়েছে যেন। উপন্যাসে যত সহজে ধর্মচিন্তায় ঘেঁটে যাওয়া পাইয়ের চিত্রণ সম্ভব হয়েছে পর্দায় সেই দ্বন্দ্ব ঠিক ততখানি বিশ্বাসযোগ্য হল কই? বয়োঃসন্ধির টানাপোড়েন হৃদয় ছুঁতে পাওয়ার আগেই স্যান্টিয়াগোর বার্দ্ধক্যে পৌঁছে গেল সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া পাই। তবে উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি বেশির ভাগ সিনেমা নিয়েই এই দ্বন্দ্ব প্রকাশ পায় দর্শক কূলে। এ সব বাদ দিয়েও লাইফ অফ পাই অনবদ্য। মনের মণিকোঠায় থেকে যাবে অ্যাং লি, সূরজ শর্মা আর শেষ না হওয়া রিচার্ড পার্কার।