রবীন্দ্রনাথের রচনা যখন বাংলা ছবিতে গভীর অনুভূতির বিশ্লেষণ
আমার চোখে সেরা তিন ছবি যার সূত্র রবীন্দ্রনাথ।
অতনু ঘোষ
রবীন্দ্রকাহিনির তিনটি সার্থক রূপ আমার কাছে 'পোস্টমাস্টার', 'চারুলতা' এবং 'অতিথি'। 'পোস্টমাস্টার'-এর ক্ষেত্রে প্রথমেই যেটা বলতে হয় অনবদ্য নির্বাচন। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের যে অসাধারণ প্রকাশ, মানুষের মনের গভীর টানাপোড়েন, খুব সুক্ষ মনোস্তাত্বিক স্তর নিয়ে নাড়াচাড় করা। এগুলো সত্যজিৎ রায়ের মত পরিচালক বলেই এতটা দরদ, এতটা সংবেদনশীলতা নিয়ে ছবিতে এসেছে। এখানে আর একটা কথা বলতেই হয়, পরিচালকের কী অসীম সাহস এবং আত্মবিশ্বাস প্রকাশ পেয়েছে। ওই যে পোস্টারমাস্টার গল্পের যে শেষ অংশ, শেষ দুটো প্যারাগ্রাফ, কী গভীর অনুভূতির একটা বিশ্লেষণ সেখানে রয়েছে। ওই যখন 'নৌকায় উঠিলেন, নৌকা ছাড়িয়া দিল, বর্ষা বিস্ফারিত নদী, ধরণীর অশ্রুরাশির মত চারিদিক ছলছল করিতে লাগিল'-ওই যে জায়গাটা মানে এমন একটা সাহিত্যিক বৈশিষ্ট সেটা সিনেমার ভাষায় প্রকাশ করা এটা আবার ওই একই কথা বলতে হয় যে তা সত্যজিৎ রায় বলেই সম্ভব হয়েছে।
চারুলতার ক্ষেত্রে আবার সত্যজিৎ রবীন্দ্রনাথের 'নষ্টনীড়'- কে সিনেমার ভাষা প্রয়োগ করে এমন একটা বিশ্বাসযোগ্যতার জায়গায় নিয়ে গেছেন যা একেবার ক্লাসিক। আমার তো মনে হয় আজও এই ছবি ততটাই প্রাসঙ্গিক যতটা সেইসময় ছিল। এই গল্পে রবীন্দ্রনাথের ভাষার মধ্যে যে তীব্রতা, আমি তীব্রতাই বলব কারণ সত্যজিৎ তাঁকে এত আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখেছেন সেটা আমার কাছে অসাধারণ মনে হয় চারুলতার ক্ষেত্রে। এই যে অমল ও চারুলতার সম্পর্কের যে মূল বৈশিষ্ট সেটা আজও সমকালীন। অমলের জন্য চারুর যে বিরহ, যে অস্থিরতা আবার অন্য দিকে স্বামীর কাছে পৌঁছতে না পারার যে আড়ষ্ঠতা, এগুলো আমি এখন যখন এখন এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আলোচনা করি, আমি দেখি তাঁরা অনায়াসে কানেক্ট করতে পারে। মানে দুটো মানুষ কাছাকাছি আসতে চায়, পারছে না, মাঝের দরজায় যতই ধাক্কা দেয় সেটা যেন আরও শক্ত হয়ে এঁটে যায়। এই যে একটা চেতন অবচেতনের মধ্যের তুমুল টানাপোড়েন সেটা একেবারে টাইমলেস করে দিয়ে গেছেন সত্যজিৎ 'চারুলতা'-র ক্ষেত্রে। কাজেই চারুলতা আমার কাছে প্রেমের একটা চিরকালীন ডেফিনেশন বা ইন্টারপ্রিটেশন যাই বলি না কেন, যেটা সৎ, স্বাভাবিক, সুন্দর এবং তুমুলভাবে বিশ্বাসযোগ্য।
আরও পড়ুন:সব রকম সংকীর্ণতার নাগপাশ ছিন্ন করার গ্রীষ্মসাধনই তাঁর নিজস্ব 'বৈশাখ'
তপন সিংহের 'অতিথি' আমি প্রথম দেখি দুরদর্শনে। তখন শনিবার সন্ধেবেলায় সিনেমা দেখানো হত। প্রথম যখন এই ছবি দেখি আমি চমকে উঠেছিলাম, কারণ তখন সবে সাহিত্য নিয়ে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে, প্লট ক্যারেকটারাইজেশন ইত্যাদি সাহিত্যে কীভাবে আসে,সিনেমায় তাাঁর কী পরিবর্তিত রূপ। এগুলোর কৌতুহল তৈরি হচ্ছে। তখন অবাক হয়ে ভেবেছিলাম এরকম একটা তুমুল লিরিসিজম যে গল্পে, সংলাপ প্রায় নেই বললেই চলে। এবং আমরা যদি ভাবি প্রধান ভাবনা এই গল্পের প্রধান ভাবনা কী, প্রধান থিম কী। সেটা হল মানুষের মন মু্ক্তি খুঁজছে। একটা ছন্নছাড়া বোহমিয়ানিজম, পালিয়ে বেড়ানোর একটা অদম্য তাগিদ, এই গুলো কী করে একটা বাংলা সিনেমার বিষয় হতে পারে? বিশেষত সেই সময়, 'অতিথি' ১৯৬৫ সালের ছবি। সেইসময় কিন্তু মূলধারার বাংলা সিনেমা একদম নিটোল গল্প বলছে, আর সেই গল্প বলাকেই প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে এবং সেখানে এই ছবিতে গল্প নেই বললেই চলে। 'অতিথি' ছবির ভাব, বিন্যাস, চলন সবটাই যেন বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রে একটা নতুন ভাষা খোঁজার চেষ্টা এবং সেটা রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে। আরেকটা কথা শেষে বলতেই হয় গানের প্রয়োগ। রবীন্দ্রসঙ্গীত, 'ওকে ধরিলে তো ধরা দেবেনা, ওকে দাও ছেড়ে দাও ছেড়ে' ওটাও অসাধারণ। এমন একটা দৃশ্যকল্প যেটা সিনেমার ভিতরে যে মুক্তি খোঁজা সেখান থেকে সরে এসে যেন আমাদের মনের গভীরেও কড়া নাড়ছে, আমরাও যেন চাইছি মুক্তি। এইভাবেই যেন ভাব সঞ্চারিত হচ্ছে আমাদের মনে। তপন সিনহার মত পরিচালকই বোধহয় ভাবতে পারতেন যে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত একজন শিল্পীকে নিয়ে, অসাধারণ শিল্পী তিনি, কিন্তু তাঁর একটা অন্যধরনের ইমেজ ছিল, সেইটা ভেঙ্গে গানের মাস্টার করে দেওয়া হয়েছে যিনি এসরাজ বাজিয়ে গান শেখান। আমার তো মনে হয় 'অতিথি' রবীন্দ্রনাথের গল্প অবলম্বনে এক্সপেরিমেনটেশনের জায়গার থেকে একটা বিরল নজির, তো সেখানেই এর জায়গাটা একেবারেই আলাদা।
(অনুলিখন)