এ-আমির-আবরণ সরিয়ে তিনি নিয়তই বর্মহীন দাঁড়াতেন কবিতার মুখোমুখি
বাঙালির সমাজ-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-ব্যক্তিক অনুভূতির সঙ্গে মিশে গিয়েছে শঙখ ঘোষের কাব্যিক উচ্চারণ!
সৌমিত্র সেন
বৈশাখ একহাতে এক কবির জন্ম দিয়েছিল, বৈশাখই অন্য হাতে এনে দিল আর এক কবির মৃত্যু! তাহলে কি টি.এস এলিয়টের সেই মর্মভেদী পঙক্তিটিই বাঙালিজীবনে সত্য হয়ে পড়ল-- 'April is the cruelest month'!
নিষ্ঠুর নয়? এই বৈশাখ, এই এপ্রিল যে আমাদের কবিশিরোমণিকে ছিনিয়ে নিল! প্রয়াত হলেন শঙ্খ ঘোষ (shankha ghosh)। কিন্তু এই যে ২০২১ সালের ২১ এপ্রিল বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ মারা গেলেন আমাদের একালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক কবি, তা স্রেফ ইতিহাসের সামগ্রী হয়ে রয়ে যাবে। আর কবি স্বয়ং মহীয়ান হয়ে রয়ে যাবেন, যেমন বরাবর তাঁরা থাকেন, আমাদের চিত্তে, স্বপ্নে, মননে, সুখে, যুদ্ধে, প্রেমে, প্রতিবাদে!
যদিও বাঙালি কবিদের কোনও কোনও গোষ্ঠী বহুদিন ধরে বলে আসছে শঙ্খ ঘোষ একজন 'ওভাররেটেড' কবি; তবু এ কথা অস্বীকার করলে ইতিহাসের সত্যকেই উড়িয়ে দেওয়া হবে যে, জীবনানন্দ দাশ-পরবর্তী (jibanananda das) বাংলা কবিতায় কবি শঙ্খ ঘোষ এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সেই সুদূর ১৯৩২ সালে তাঁর জন্ম, ১৯৫৩ সালে প্রথম কবিতাপ্রকাশ, ১৯৫৬ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ; তার পর থেকে এক সুদীর্ঘ উচ্চাবচ বন্ধুর পথরেখা পেরিয়ে তিনি এই সেদিন পর্যন্ত সৃষ্টিশীল ছিলেন, আলস্যসাধনের এই যুগে এ কম বড় কথা নয়। অধ্যাপনার পাশাপাশি কবিতার প্রতি তাঁর যে নিবিড় আত্মসমর্পণ তা বাংলা কবিতাকে কী অলৌকিক ভাবেই না মহিমান্বিত করল এতগুলি বছর ধরে।
আর তাঁর এই তদ্গত সাধনা তাঁকে এমন সহজ স্বাভাবিকতার সুরে বাঙালিচিত্তের সঙ্গে শাশ্বত ভাবে জুড়ে দিয়েছে যে, আজ জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে শঙ্খের কত উচ্চারণ, কত তির্যকতা, কত রূপক, কত অনুভব অবলীলায় বাঙালির কবিতাভাবনার সঙ্গে, তার সমাজ-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-ব্যক্তিক অনুভূতির সঙ্গে মিশে গিয়েছে!
আজ চারিদিকে এই প্রহরজোড়া ত্রিতালের ঘোরতর কলকোলাহলের মধ্যে অনায়াসেই কি আমাদের মন বিড়বিড় করে বলে ওঠে না 'মূর্খ বড়ো সামাজিক নয়' গ্রন্থের 'আয়ু' কবিতার সেই অমর পঙক্তি-- 'এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো/শব্দহীন হও/শষ্পমূলে ঘিরে রাখো আদরের সম্পূর্ণ মর্মর'? কিংবা সন্তান বা পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি আমাদের ঐকান্তিক আবেগ প্রকাশ করতে গিয়ে আমরা কি বিনা চেষ্টাতেই বলে উঠি না 'বাবরের প্রার্থনা'র সেই 'এই তো জানু পেতে বসেছি, পশ্চিম/আজ বসন্তের শূন্য হাত--/ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও/আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক। আমারই হাতে এত দিয়েছ সম্ভার /জীর্ণ করে ওকে কোথায় নেবে?/ ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর/আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক'! যে-পঙক্তি 'আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে'র মতো কালজয়ী একটি পঙক্তির একটা পোয়েটিক এক্সটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে যায় যেন!
এই সৃষ্টিশীল মনটিকে কী ভাবে ভুলবে বাঙালি? যিনি সারাদিনের সমস্ত সাধারণ কাজের দাবি মিটিয়ে, সংসারের সমস্ত দাবি পূরণ করেও শেষমেশ কবিতার কাছে বর্মহীন দাঁড়াতে চান এবং সন্দিহান হয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করেন, এভাবে কবিতার কাছে দাঁড়াতে গিয়ে কি তাঁর পক্ষে কোনও চপলতা ঘটেছে? বাঙালি কি ভুলতে পারে 'পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ' গ্রন্থের ৩৫ নম্বর কবিতার সেই নিবিড় আর্তি-- 'আমি কি মৃত্যুর চেয়ে ছোট হয়ে ছিলাম সেদিন?/ আমি কি সৃষ্টির দিকে দুয়ার রাখিনি খুলে কাল?'
আরও পড়ুন: কৃষ্ণগহ্বরের সৃষ্টি হল বাংলা সাহিত্যে, মন খারাপ শীর্ষেন্দুর
হ্যাঁ, সৃষ্টির দিকে দরজা খুলে তিনি অবশ্যই রেখেছিলেন। রেখেছিলেন বলেই তো তাঁর সেই অন্তর্দৃষ্টি ভরা, নিজের মনের ভিতরে চোখ ফেলা, আত্মনির্জনতার অমেয় ঢেউয়ে ভেসে পড়ার সব আশ্চর্য চিহ্ন বহন করছে আমাদের বাংলা কবিতার জগৎ, আমাদের অনুভূতির পৃথিবী। সৃষ্টির দিকে সদাই মুখ করে বসে না থাকলে কোনও কবির হাত থেকে কি বেরোয় 'শবের উপর শামিয়ানা' গ্রন্থের 'অবলীন' কবিতার এই অজর পঙক্তি-- 'যে দূর দূরের নয়, যে দূর কাছের থেকে দূর/যে আকাশ ভরে আছে আকাশের ভিতরে বিধুর/যে স্বর স্বরের চেয়ে শরীরের আরো কাছাকাছি/আমার ভিতরে আমি ক্ষীণ তার প্রান্ত ছুঁয়ে আছি।'
প্রান্ত ছুঁয়ে থাকার অমোঘ চিহ্ন রয়ে গিয়েছে এরকম সব উচ্চারণে-- 'জলপাতালের চিহ্ন চরের উপরে মুখে ভাসে/ তাঁবু হয়ে নেমে আসে সূর্যপ্রতিভার রেখাগুলি/ স্তব্ধ প্রসারিত-মূল এ আমার আলস্যপুরাণ।'
যদিও কবিবাক্য আবার ব্যাহতও হয় কখনও কখনও। 'নিহিত পাতাল ছায়া'-র সেই 'বৃষ্টি' কবিতার লাইন মনে পড়ে -- 'এমন বৃষ্টির দিন পথে-পথে / আমার মৃত্যুর দিন মনে পড়ে!' কী আশ্চর্য, এলিয়টের (T.S.Eliot) ওই কবিতাংশেও বৃষ্টির অনুষঙ্গ আছে-- 'April is the cruelest month, breeding/ lilacs out of the dead land, mixing/ memory and desire, stirring/dull roots with spring rain.” বসন্তের বৃষ্টি? শঙ্খের ক্ষেত্রে অবশ্য বিষয়টা গ্রীষ্মের বৃষ্টিতে অনূদিত হতে পারে!
কিন্তু না। বৃষ্টিহীন এক গাঢ় প্রলম্বিত বদ্ধ তপ্ত নির্মম দিনেই এই মৃত্যু এল। কেমন সেই মৃত্যু? কিছু পরেই সেই উচ্চারণ-- 'এমন বৃষ্টির দিন মনে পড়ে আমার জন্মের কোনো শেষ নেই'!
কবির মৃত্যু নেই, কেননা কবির তো জন্মেরই কোনও শেষ নেই! মৃত্যুহীন এক চির-অস্তিত্বের গাথা তাই এই কবিজীবন।
আরও পড়ুন: শঙ্খ ঘোষ যেন আজকের রাজাকেও প্রশ্ন করেন, বিচার দেবার আগে জেনে নাও প্রশ্ন করো তুমি কোন্ দল!