স্বামী বিবেকানন্দর প্রথম দুর্গাপুজো
বিষয়-মঠ সম্বন্ধে নৈষ্ঠিক হিন্দুদিগের পূর্বধারণা;মঠে দুর্গোত্সব ও ঐ ধারণার নিবৃত্তি;নিজ জননীর সহিত স্মামীজীর কালীঘাটদর্শন ও ঐ স্থানের উদার ভাবসম্বন্ধে মতপ্রকাশ; স্বামীজীর ন্যায় ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের দেবদেবীর পূজা করাটা বাবিবার বিষয়। মহাপুরুষ ধর্মরক্ষার নিমিত্তই জন্মপরিগ্রহ করেন; দেবদেবীর পূজা অকর্তব্য বিবেচনা করিলে স্বামীজী কখনই ঐরূপ করিতেন না; স্বামীজীর ন্যায় সর্বগুণসম্পন্ন ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষ এ যুগে আর দ্বিতীয় জন্মগ্রহণ করেন নাই;তাঁহার প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হইলেই দেশের ও জীবের ধ্রুব কল্যাণ।
স্বামী বিবেকানন্দর প্রথম দুর্গাপুজো
সপ্তদশ বল্লী
স্থান-বেলুড় মঠ।। বর্ষ-১৯০১ খ্রীষ্টাব্দ।
বিষয়-মঠ সম্বন্ধে নৈষ্ঠিক হিন্দুদিগের পূর্বধারণা;মঠে দুর্গোত্সব ও ঐ ধারণার নিবৃত্তি;নিজ জননীর সহিত স্মামীজীর কালীঘাটদর্শন ও ঐ স্থানের উদার ভাবসম্বন্ধে মতপ্রকাশ; স্বামীজীর ন্যায় ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের দেবদেবীর পূজা করাটা বাবিবার বিষয়। মহাপুরুষ ধর্মরক্ষার নিমিত্তই জন্মপরিগ্রহ করেন; দেবদেবীর পূজা অকর্তব্য বিবেচনা করিলে স্বামীজী কখনই ঐরূপ করিতেন না; স্বামীজীর ন্যায় সর্বগুণসম্পন্ন ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষ এ যুগে আর দ্বিতীয় জন্মগ্রহণ করেন নাই;তাঁহার প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হইলেই দেশের ও জীবের ধ্রুব কল্যাণ।
বেলুড় মঠ স্থাপিত হইবার সময় নৈষ্ঠিক হিন্দুগমের মধ্যে অনেকে মঠের আচার-ব্যবহারের প্রতি তীব্র কটাক্ষ করিতেন। বিলাত প্রত্যাগত স্বামীজী কর্তৃত স্থাপিত মঠে হিন্দুর আচারনিষ্ঠা সর্বথা প্রতিপালিত হয় না এবং ভক্ষ্যভোজ্যাদির বাচ-বিচার নাই প্রধানতঃ এই বিষয় লইয়া নানা স্থানে আলোচনা চলিত এবং ঐ কথায় বিশ্বাসী হইয়া শাস্ত্রানভিজ্ঞ হিন্দুনামধারী ইতর ভদ্র অনেকে তখন সর্বত্যাগী সন্ন্যাসিগণের কার্যকলাপের অযথা নিন্দাবাদ করিত। চলতি নৌকার আরোহিগণ বেলুড় মঠ দেখিয়াই নানারূপ ঠাট্টাতামাশা করিত এবং এমন কি, সময় সময়, অলীক অশ্লীল কুত্সা অবতারণা করিয়া নিষ্কলঙ্ক স্বামীজীর অমলধবল চরিত্র-আলোচনাতেও কুণ্ঠিত হইত না। নৌকায় করিয়া মঠে আসিবার কালে শিষ্য সময়টে সময়ে ঐরূপ সমালোচনা স্বকর্ণে শুনিয়াছে। তাহার মুখে স্বামীজী কখনো কখনো ঐসকল সমালোচনা শুনিয়া বলিতেন, "হাতি চলে বাজারমে, কুত্তা ভোকে হাজার। সাধুন্কো দুর্ভাব নহি,যব নিন্দে সংসার।।"কখনো বলিতেন, "দেশে কোন নতুন ভাব প্রচার হওয়ার কালে তাহার বিরুদ্ধে প্রাচীনপন্তাবলম্বিগণের অভুত্থান প্রকৃতির নিয়ম। জগতের ধর্মসংস্থাপকমাত্রকেই এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়েছে।
আবার কখনো বলিতেন,"persecution (অন্যায় অত্যাচার) না হলে জগতের হিতকর ভাবগুলি সমাজের অন্তস্তলে সহজে প্রবেশ ,করতে পারে না। সুতরাং সমাজের তীব্র কটাক্ষ ও সমালোচনাকে স্বামীজী তাঁহার নবভাবপ্রচারের সহায় বলিয়া মনে করিতেন, কখনো উহার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করিতেন না বা তাঁহার পদাশ্রিত গৃহী ও সন্ন্যাসিগণকে প্রতিবাদ করিতে দিতেন না। সকলকে বলিতেন, "ফলাভিসন্ধিহীন হয়ে কাজ করে যা, একদিন ওর ফল নিশ্চয় মিলবে।"স্বামীজীর শ্রীমুখে একথাও সর্বদাই শুনা যাইত, ন হি কল্যাণকৃত্ কশ্চিত্ দুর্গতিং তাত গচ্ছিত।"
হিন্দুসমাজের তীব্র সমালোচনা স্বামীজীর লীলাবসানের পূর্বে কিরূপে অন্তর্হিত হয়, আজ সেই বিষয়ে কিছু লিপিবদ্ধ হইতেছে। ১৯০১ খ্রীষ্টাব্দের মে কি জুন মাসে শিষ্য একদিন মঠে আসিয়াছে। স্বামীজী শিষ্যকে দেখিয়াই বলিলেন, ওরে একখানা রঘুনন্দনের অষ্টবিংশতি-তত্ত্ব শিগ্গরি আমার জন্যে নিয়ে আসবি।"
শিষ্য। আচ্ছা মহাশয়। কিন্তু রঘুনন্দনের স্মৃতি-যাহাকে কুসংস্কারে ঝুড়ি বলিয়া বর্তমান শিক্ষিত সম্প্রদায় নির্দেশ করিয়া থাকে, তাহা লইয়া আপনি কি করিবেন?
স্বামীজী। কেন?রঘুনন্দন তদানীন্তন কালের একজন দিগগজ পণ্ডিত ছিলেন-প্রাচীন স্মৃতিসকল সংগ্রহ করে হিন্দুর দেশকালোপযোগী নিত্যনৈমিত্তিক ক্রিয়াকলাপ করে গেছেন। সমস্ত বাংলা দেশ তো তাঁর অনুশাসনেই আজকাল চলছে। তবে তত্কৃত হিন্দু জীবনের গর্ভাধান হতে শ্মশানান্ত আচার-প্রণালীর কঠোর বন্ধনে কঠোর বন্ধনে সমাজ উত্পাড়িত হয়েছিল। শৌচ-প্রসাবে, খেতে-শুতে,অন্য সকল বিষয়ের কথাই নেই, সব্বাইকে তিনি নিয়মে বদ্ধ করতে প্রয়াস পেয়েছিলেন। সময়ের পরিবর্তনে সে বন্ধব বহুকাল স্থায়ী হতে পারল না। সর্বদেশে, সর্বকালে, ক্রিয়াকাণ্ড-সমাজের আচার-প্রণালী সর্বদাই পরিবর্তিত হয়ে যায়। একমাত্র জ্ঞানকাণ্ডই পরিবর্তিত হয় না। বৈদিক যুগেও দেখতে পাবি ক্রিয়াকাণ্ড ক্রমেই পরিবর্তিত হয়ে গেছে। কিন্তু উপনিষদের জ্ঞানপ্রকরণ আজ পর্যন্তও একভাবে রয়েছে। তবে তার interpreters (ব্যাখ্যাতা)অনেক হয়েছে-এইমাত্র।
শিষ্য। আপনি রঘুনন্দনের স্মৃতি লইয়া কি করিবেন?
স্বামীজী। এবার মঠে দুর্গোত্সব করবার ইচ্ছে হচ্ছে!যদি খরচার সঙ্কুলান হয় তো, মহামায়ার পুজো করব। তাই দুর্গোত্সববিধি পড়বার ইচ্ছে হয়েছে। তুই আগামী রবিবারে যখন আসবি, তখন ঐ পুঁথিখানি সংগ্রহ করে নিয়ে আসবি।
শিষ্য। যে আজ্ঞা।
পর রবিবারে শিষ্য রঘুনন্দনকৃচ অষ্টাবিংশতি-তত্ত্ব ক্রয় করিয়া স্বামীজীর জন্য মঠে লইয়া আসিল। গ্রন্থখানি আজিও মঠের লাইব্রেরিতে রহিয়াছে। স্বামীজী পুস্তকখানি পাইয়া বড় খুশি হইলেন এবং ঐ দিন হইতে উহা পাঠ করিতে আরম্ভ করিয়া ৪-৫ দিন গ্রন্থখানি আদ্যোপান্ত পাঠ করিয়া ফেলিলেন। শিষ্য়ের সঙ্গে সপ্তাহান্তে দেখা হইবার পর বলিলেন, তোর দেওয়া রঘুনন্দনের স্মৃতিখানি সব পড়ে ফেলেছি। যদি পারি তো এবার মার পুজো করব। রঘুনন্দন বলেছেন, "নবম্যাং পূজয়েত্ দেবীং কৃত্বা রুধিরকর্দমম-মার ইচ্ছা হয় তো করব।"
শিষ্যের সহিত স্বামীজীক উপরোক্ত কথাগুলি পূজার তিন-চার মাস পূর্বে হয়। পরে ঐ সম্বন্ধে কোন কথাই মঠের কাহারও সহিত করেন নাই। পরন্তু তাহার ঐ সময়ের চালচলন দেখিয়ে শিষ্যের মনে হইত যে, তিনি ঐ সম্বন্ধে আর কিছুই ভাবেন নাই। পূজার ১০-১২ দিন পূর্ব পর্যন্ত মঠে য়ে প্রতিমা আনয়ন করিয়া এ বত্সর পূজা হইবে, একথার কোন আলোচনা বা পূজা সম্বন্ধে কোন আয়োজন শিষ্য মঠে দেখিতে পায় নাই। স্বামীজীর জনৈক গুরুভ্রাতা ইতোমধ্যে একদিন স্বপ্নে দেখেন যে, মা দশভূজা গঙ্গার উপর দিয়া দক্ষিণেশ্বরের দিক হইতে মঠের দিকে আসিতেছেন! পরদিন প্রাতে স্বামীজী মঠের সকলের নিকট পূজা করিবার সঙ্কল্প প্রকাশ করিলে, তিনিও তাঁহার নিকট স্বীয় স্বপ্নবৃত্তান্ত প্রকাশ করিলেন। স্বামীজীও তাহাতে আনন্দিত হইয়া বলিলেন, "যেরূপে হোক, এবারে মঠে পুজো করতেই হবে।" তখন পুজো করা স্থির হইল এবং ঐদিনই একখানা নৌকা ভাড়া করিয়া স্বামীজী, স্বামী প্রেমানন্দ ও ব্রহ্মচারী কৃষ্ণলাল বাগবাজারে চলিয়া আসিলেন;অভিপ্রায়- বাগবাজারে অবস্থিত শ্রীরামকৃষ্ণভক্তজননী শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানীর নিকট কৃষ্ণলাল ব্রহ্মচারীকে পাঠাইয়া ঐ বিষয়ে তাঁহার অনুমতি প্রার্থনা করা এবং তাঁহারই নামে সঙ্কল্প করিয়া ঐ পূজা সম্পন্ন উইবে, ইহা জ্ঞাপন করা। কারণ সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীদিগের কোনরূপ পূজা বা ক্রিয়া `সঙ্কল্প` করিয়া করিবার অধিকার নাই।
শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানী স্বীকৃতা হইলেন এবং মঠের পূজা তাঁহারই নামে সঙ্কলিত হইবে, স্থির হইল। স্বামীজীঔ ঐজন্য বিশেষ আনন্দিত হইলেন এবং ঐদিনেই কুমারটুলিতে প্রতিমার বায়না দিয়া মঠে প্রত্যাগমন করিলেন। স্বামীজীক পূজা করিবার কথা সর্বত্র প্রচারিত হইল এবং ঠাকুরের গৃহী ভক্তগণ ঐ কথা শুনিয়া উহার আয়োজনে আনন্দে যোগদান করিলেন।
-------------
স্বামী ব্রহ্মানন্দের উপরে পুজোপকরণ সংগ্রহের ভার পড়িল। কৃষ্ণলাল
ব্রহ্মচারী পূজক হইবেন স্থির হইল। স্বামী রামকৃষ্ণানন্দের পিতৃদেব
সাধকাগ্রণী শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয় তন্ত্রধারকপদে ব্রতী
হইলেন। মঠে আনন্দ ধরে না। যে জমিতে এখন ঠাকুরের জন্মমহোত্সব হয়, সেই জমির
উত্তর ধারে মণ্ডপ নির্মিত হইল। ষষ্ঠীর বোধনের দুই-একদিন পূর্বে কৃষ্ণলাল,
নির্ভয়ানন্দ প্রভৃতি সন্ন্যাসী ও ব্রহ্মচারীগণ নৌকা করিয়া মায়ের প্রতিমা
মঠে লইয়া আসিলেন। ঠাকুরঘরে নিচের তলায় মায়ের মূর্তিখানি আনিয়া রাখিবামাত্র,
যেন আকাশ ভাঙিয়া পড়িল-অবিশ্রান্ত বারিবর্ষণ হইতে লাগিল। মায়ের প্রতিমা
নির্বিঘ্নে মঠে পৌঁছিয়াছে,এখন জল হইলেও কোন ক্ষতি নাই ভাবিয়া স্বামীজী
নিশ্চিন্ত হইলেন।
এদিকে স্বামী ব্রহ্মানন্দের যত্নে দ্রব্যসম্ভারে পরিপূর্ণ, পুজোপকরণের
কিছুমাত্র ত্রুটি নাই দেখিয়া স্বামীজী স্বামী ব্রহ্মানন্দ প্রভৃতির প্রশংসা
করিতে লাগিলেন। মঠের দক্ষিণের বাগানবাটীখানি-যাহা পূর্বে নীলাম্বরবাবুর
ছিল, একমাসের জন্য ভাড়া করিয়া পূর্বদিন হইতে শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানীকে আনিয়া
রাখা হইল। অধিবাসের সান্ধ্য-পূজা স্বামীজীর সমাধিমন্দির এখন যেখানে
অবস্থিত তাহার সম্মুখস্থ বিল্ববৃক্ষমুলে সম্পন্ন হইল। তিনি ঐ
বিল্ববৃক্ষমূলে বসিবার পূর্বে একদিন যে গান গাহিয়াছিলেন-"বিল্ববৃক্ষমূলে
পাতিয়া বোধন, গণেশের কল্যাণে গৌরীর আগমন", ইত্যাদি, তাহা এতদিনে অক্ষরে
অক্ষরে পূর্ণ হইল।
শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানীর অনুমতি লইয়া ব্রহ্মচারী কৃষ্ণলাল মহারাজ সপ্তমীর
দিনে পুজকের আসনে উপবেশন করিলেন। কৌলাগ্রণী তন্ত্রমন্ত্রকোবিদ্
ঈশ্বরচন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয়ও শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানীর আদেশে সুরগুরু
বৃহস্পতির ন্যায় তন্ত্রধারকের আসন গ্রহণ করিলেন। যথাশাস্ত্র মায়ের পূজা
নির্বাহিত হইল। কেবল শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানীর অনভিমত বলিয়া মঠে পশুবলিদান হইল
না। বলির অনুকল্পে চিনির নৈবেদ্য ও স্তুপকৃত মিছ্টান্নের রাশি প্রতিমার
উভয়পার্শ্বে শোভা পাইতে লাগিল।
গরিব-দুঃখী-কাঙাল-দরিদ্রগিদকে দেহধারী ঈশ্বরজ্ঞানে পরিতোষপূর্বক ভোজন করান
এই পুজোর প্রধান অঙ্গরূপে পরিগণিত হইয়াছিল। এতদ্ব্যতীত বেলুড়, বালি
উত্তরপড়াক পরিচিত অপরিচিত অনেক ব্রাক্ষণপণ্ডিতকেও নিমন্ত্রণ করা হইয়াছিল
এবং তাঁহারাও সকলে আনন্দে যোগদান করিয়াছিলেন। তদবধি মঠের প্রতি তাঁহাদের
পূর্ববিদ্বেষ বিদূরিত হইয়া ধরামা জন্মে যে, মঠের সন্ন্যাসীরা যথার্থ
হিন্দুসন্ন্যাসী।
সে যাহাই হউক, মহাসমারোহে.দিনত্রয়ব্যাপী মহোত্সবকল্লোলে মঠ মুখরিত হইল।
নহবতের সুললিত তানতরঙ্গ গঙ্গার পরপারে প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। ঢাক-ঢোলের
রুদ্রতালে কলনাদিনী ভাগীরথী নৃত্য করিতে লাগিল। দীয়াতং নীয়াতং ভূজ্যকাম-কথা
ব্যতীত মঠস্থ সন্ন্যাসিগমের মুখে ঐ তিন দিন আর কোন কথা শুনিতে পাওয়া যায়
নাইর য়ে পূজায় সাক্ষাত্ শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানী স্বয়ং উপস্থিত, যাহা
স্বামীজীর সঙ্কল্পিত, দেহের দেবসদৃশ মহাপুরষগণ যাহার কার্যসম্পাদক, সে পূজা
যে অচ্ছিদ্র হইবে তাহাতে আর বিচিত্র কি! দিনত্রয়ব্যাপী পূজা নির্বিঘ্নে
সম্পন্ন হইল। গরিব-দুঃখীর বোজন-তৃপ্তিসূচক কলরবে মঠ তিন দিন পরিপূর্ণ হইল।
মহাষ্টণীর পূর্বরাত্রে স্বামীজীর জ্বর হইয়াছিল। সেজন্য তিনি পরদিন পূজায়
যোগদান করিতে পারেন নাই;কিন্তু সন্ধিক্ষণে উঠিয়া জবাবিল্বদলে মহামায়ার
শ্রীচরণে বরাত্রয় পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করিয়া স্বীয় কক্ষে প্রত্যাবর্তন
করিয়াছিলেন। নবমীর দিন তিনি সুস্থ হইয়াছিলেন এবং শ্রীরামকৃষ্ণদেব নবমী
রাত্রে যে সকল গান গাহিতেন, তাহার দুই-একটি স্বয়ং গাহিয়াও ছিলেন। মঠে সে
রাত্রে আনন্দের তুফান বহিয়াছিল।
নবমীর দিন পূজাশেষে শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানীর দ্বারা যজ্ঞ দক্ষিণান্ত করা উইল।
যজ্ঞের ফোঁটাধারণ এবং সঙ্কল্পিত পূজা সমাধা করিয়া স্বামীজীর মুখমণ্ডল
দিব্যবাবে পরিপূর্ণ হইয়াছিল। দশমীর দিন সন্ধ্যান্তে মায়ের প্রতিমা গঙ্গাতে
বির্সজন করা হইল। এবং তত্পরদিন শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানীও স্বামীজীপ্রমুখ
সন্ন্যাসিগণকে আশীর্বাদ করিয়া বাগবাজারে পূর্বাবাসে প্রত্যাগমন করিলেন।
দুর্গোত্সবের পর স্বামীজী মঠে শ্রীশ্রীলক্ষ্মী ও শ্রীশ্রীশ্যামাপূজাও
প্রতিমা আনাইয়া ঐ বত্সর যথাশাস্ত্র নির্বাহিত করেন। ঐ পূজাতেও শ্রীযুক্ত
ঈশ্বরচন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয় তন্ত্রধারক এবং কৃষ্ণলাল মহারাজ পুজক ছিলেন।
শ্যামাপূজান্তে স্বামীজীর জননী মঠে একদিন বলিয়া পাঠান যে, বহুপূর্বে
স্বামীজীর বাল্যকালে তিনি একসময় `মানত` করিয়াছিলেন যে. একদিন স্বামীজীকে
সঙ্গে লইয়া কালীঘাট গিয়া মহামায়ার পূজা দিবেন, উহা পূর্ণ করা নিতান্ত
প্রয়োজন। জননীর নির্বন্ধাতিশয়ে স্বামীজী অগ্রহায়ণ মাসের শেষভাগে শরীর
অসুস্থ হইয়া পড়িলেও একদিন কালীঘাটে গিয়াছিলেন। ঐদিন কালীঘাটে পূজা দিয়া
মঠে ফিরিয়া আসিবার সময়ে শিষ্যের সহিত তাঁহার সাক্ষাত্ হয় এবং কি ভাবে তথায়
পূজাদি দেন, তাহা শিষ্যকে এস্থলে লিপিবদ্ধ হইল।
ছেলেবেলায় স্বামীজীর একবার বড় অসুখ হয়। তখন তাঁহার জননী `মানত`করেন যে,
পুত্র আরোগ্যলাভ করিলে কালীঘাটে তাহাকে লইয়া যাইয়া মায়ের বিশেষ পূজা দিবেন
এবং শ্রীমন্দিরে তাহাকে গড়াগড়ি দেওয়াই লইয়া আসিবেন। ঐ মানতের কথা এতকাল
কাহারও মনে ছিল না। ইদানীং স্বামীজীর শরীর অসুস্থ হওয়ায়,তাঁহার গর্ভধারিণীর
ঐ কথা স্মরণ হয় এবং তাঁহাকে ঐ কথা বলিয়া কালীঘাটে লইয়া যান। কালীঘাটে
যাইয়া স্বামীজী কালীগঙ্গায় স্নান করিয়া জননীর আদেশে আর্দ্রবস্ত্র মায়ের
মন্দিরে প্রবেশ করেন এবং মন্দিরের মধ্যে স্রীশ্রীকালীমাতার পাদপদ্মের
সম্মুখে তিনবার গড়াগড়ি দেন। তত্পরে মন্দির হইতে বাহির হইয়া সাতবার
মন্দির প্রদক্ষিণ করেন। পরে নাটমন্দিরের পশ্চিমপার্শ্বে অনাবৃত চত্বরে
বসিয়া নিজেই হোম করেন। অমিত বলবান তেজস্বী সন্ন্যাসীর সেই ষজ্ঞসম্পাদন
দর্শন করিতে মায়ের মন্দিরে সেদিন খুব ভিড় হইয়াছিল। শিষ্যের বন্ধু কালীঘাট
নিবাসী শ্রীযুক্ত গিরীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, যিনি শিষ্যের সঙ্গে বহুবার
স্বামীজীর নিকট যাতায়াত করিয়াছিলেন, ঐ যজ্ঞে স্বয়ং দর্শন করিয়াছিলেন।
জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে পুনঃপুনঃ ঘৃতাহুতি প্রদান করিয়া সেদিন স্বামীজী
দ্বিতীয় ব্রহ্মের ন্যায় প্রতীয়মান হইয়াছিলেন বলিয়া গিরীন্দ্রবাবু ঐ ঘটনা
আজও বর্ণনা করিয়া থাকেন। সে যাই হউক, ঘটনাটি শিষ্যকে পূর্বোক্ত ভাবে
শুনাইয়া স্বামীজী পরিশেষে বলিলেন, কালীঘাটে এখনো কেমন উদার ভাব
দেখলুম;আমাকে বিলাতপ্রত্যাগত `বিবেকানন্দ`বলে জেনেও মন্দিরাধ্যক্ষগণ
মন্দিরে প্রবেশ করিতে কোন বাধাই দেননি, বরং পরম সমাদরে মন্দিরমধ্যে নিয়ে
গিয়ে যথেচ্ছ পূজা করতে সাহায্য করেছিলেন।"
এইরূপে জীবনের শেষভাগেও স্বামীজী হিন্দুর অনুষ্ঠেয় পূজা-পদ্ধতির প্রতি
আন্তরিক ও বাহ্য বহু সম্মান প্রদর্শন করিয়াছিলেন। যাঁহারে তাঁহাকে
কেবলমাত্র বেদান্তবাদী বা ব্রহ্মজ্ঞানী বলিয়া নির্দেশ করেন,এই পূজানুষ্ঠান
প্রভৃতি তাঁহাদিগের বিশেষরূপে ভাবিবার বিষয়। আমি শাস্ত্রমর্যাদা নষ্ট করিতে
আসি নাই, পূর্ণ করিতে আসিয়াছি।
-I have come to fulfill and not to
destroy."-উকক্তিটির সফলতা স্বামীজী ঐরূপে নিজ জীবনে বহুধা প্রতিপালন করিয়া
গিয়াছেন। বেদান্তকেশরী শ্রীশঙ্করাচার্য বেদান্ত নির্ঘোষে ভূলক কম্পিত
করিয়াও যেমন হিন্দুর দেবদেবীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করিতে ক্রটি করেন
নাই-ভক্তিপ্রণোদিত হইয়া নানা স্তবস্তুতি রচনা করিয়াছিলেন, স্বামীজীও তদ্রুপ
সত্য ও কর্তব্য বুঝিয়াই পূর্বোক্ত অনুষ্ঠানসকলের দ্বারা হিন্দুধর্মের
প্রতি বহু সম্মান প্রদর্শন করিয়া গিয়াছেন। রূপে,গুণে, বিদ্যায়, বাগ্মীতায়,
শাস্ত্রব্যাখায়,লোক-কল্যাণ-কামনায়,সাধনায় ও জিতেন্দিয়তায় স্বামীজীর তুল্য
সর্বজ্ঞ সর্বদর্শী মহাপুরুষ বর্তমান শতাব্দীতে আর কেহই জন্মগ্রহণ করেন নাই।
ভারতের ভবিষ্যত বংশাবলী ইহা ক্রমে বুঝিতে পারিবে। তাঁহার সঙ্গলাভ করিয়া
আমার ধন্য ও মুগ্ধ হইয়াছে বলিয়াই, এই শঙ্করোপম মহাপুরুষকে বুঝিবার ও
তদাদর্শে জীবন গঠন করিবার জন্য জাতিনির্বিশেষে ভারতের যাবতীয় নরনারীকে
আহ্বান করিতেছে। জ্ঞানে শঙ্কর, সহৃদয়তায় বুদ্ধ, ভক্তিতে নারদ, ব্রহ্মতায়
শুকদেব, তর্কে বৃহস্পতি, রূপে কামদেব, সাহসে অর্জুন এবং শাস্ত্রজ্ঞানে
ব্যাসতুল্য স্বামীজীর সম্পূর্ণতা বুঝিবার সময় উপস্থিত হইয়াছে। সর্বতোমুখী
প্রতিভাসম্পন্ন শ্রীস্বামীজীর জীবনই যে বর্তমান যুগে আদর্শরূপে একমাত্র
অবলম্বনীয়, তাহাতে কারও সন্দেহ নাই। এই মহাসমন্বয়াচার্যের সর্বমতসমঞ্জসা
ব্রহ্মবিদ্যার তমোনশী কিরণজালে সসাগরা ধরা আলোকিত হইয়াছে। হে
ভ্রাতঃ,পূর্বাকাশে এই তরুণারুণচ্ছটা দর্শন করিয়া জাগরিত হও, নবজীবনের
প্রাণস্পন্দন অনুভব কর।