Last Updated: February 14, 2013 22:07
পার্থ প্রতিম চন্দ্রএই রাজ্যে ভূতেরা এখন ভালো আছে। বেড়াতে যাচ্ছে, নাটক করছে, গান শুনছে, উত্সব করছে, যাত্রা শুনতে যাচ্ছে, পিঠে-পুলি খাচ্ছে। ভূত প্রদেশের আত্মহত্যা রাজ্যের নতুন পেতনি প্রধানের মাইক হাতে এই কথাগুলো শুনে হাসি পাচ্ছিল চ্যাঙের। মানুষের মত ভূতেরাও এখন রাজনীতিতে পাকা হয়ে গেছে। বিয়েবাড়ির মত ভূতাজিক অনুষ্ঠানেও এখানকার পেত্নি প্রধান যেভাবে রাজনৈতিক প্রচার করছেন সেটা সত্যিই হাস্যকর আর বোধহয় অপরাধও।
তা ছাড়া ভূতেরা এখন ভাল আছে দাবিটা ডাহা মিথ্যা। একে তো এটা এমন একটা রাজ্য যেখানে শুধু আত্মহত্যা করা প্রাণীরাই বাস করে, যার ফলে অতৃপ্তিটা একেবারে বংশজাত। তার ওপর এ রাজ্যে চমকের জন্য অনেক মাছ বলিদান দিয়ে ত্রিফলা বাতি লাগিয়ে ভূতেদের অস্তিত্বটাই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে।
তবে এসব মোটা দাগের বিষয়গুলো চ্যাঙের কাছে আসল খারাপ লাগার বিষয় নয়। চ্যাঙের কাছে এ রাজ্যের সব কিছুই খারাপ লাগে। এই যে এখানকার ভূতগুলো কারও গলা নেই, কারও পা নেই কি বিশ্রি দেখতে। তার চেয়েও বড় কথা বেশিরভাগ ভূতেরাই মানুষ অবস্থায় আত্মহত্যা করেছে ভালবাসার জন্য। চ্যাঙের আপত্তিটা এখানেই। একটা মানুষ, আরেকজনকে ভালবাসাবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু ছেড়ে চলে গেছে বলে, কিংবা প্রস্তাবে রাজি হয়নি বলে তার জন্য আত্মহত্যা করতে হবে এটা বোকা বোকা, যুক্তিহীন ব্যাপার। এই যে বিয়েবাড়িতে তার কিছুটা সামনের সারিতে বসে ঝোলা নামের ভূতটা ওকে দেখতে ঘেন্না করে চ্যাঙের। মানুষ থাকা অবস্থায় দশ বছর ধরে একটা মেয়েকে প্রেম করত ও, কিন্তু সেই সম্পর্কটা ভেঙে মেয়েটা অন্য একজনকে বিয়ে করে নেয়। সেই দুঃখে নিজের ঘরে পাখায় ঝুলে পড়ে আত্মহত্যা করে। তাই ওর নাম ঝোলা ভূত। ঝোলার পাশেই দাঁড়িয়ে মেট্রো ভূত। ও দুবার চেষ্টার পর চাঁদনিচক মেট্রো স্টেশনে চাঁদনি নামের একটা মেয়ের জন্য আত্মহত্যা করে। তাই ওর নাম মিস্টার মেট্রো। ওদের দেখলে গা`টা ঘিনঘিন করে চ্যাঙের।
আর ভাবে, এরা কি রকম! সামান্য একটা প্রেমের জন্য কেউ এভাবে নিজের জীবনকে বিসর্জন দেয়!
এর বাইরেও চ্যাঙের একটা খারাপ লাগা আছে। এই যে সে ভূতদের আত্মহত্যা রাজ্যের বাসিন্দা এইটা তো হওয়ার কথাই নয়। মানুষ মরে গেলে ভূতেদের কোনও রাজ্যে বাসিন্দা হবে তার একটা গাইডলাইন আছে। ধরা যাক কেউ বাস-ট্রাম-ট্রেনে চাপা পড়ে মরল, তাহলে ভূতেদের দেশে সে অপঘাত নামের রাজ্যে থাকবে। এমন করে মৃত্যুর প্রকৃতিকে ভাগ করে বিভিন্ন রাজ্য ঠিক করা হয়। ভূতেদের দেশে এমন রাজ্যের সংখ্যা এখন ২৭টা। কিন্তু কি অদ্ভুত ভূতেরা এখন আত্মহত্যা আর আত্মবলিদানের পার্থক্য করতে শেখেনি। সে তো আর আত্মহত্যা করে মরেনি। সে দেশের জন্য, সমাজের জন্য, আদর্শের স্বার্থে আত্মবলিদান করেছে। কিন্তু কী আশ্চর্য, যখন তাকে ভূতেদের দেশে ঢোকার পাসপোর্ট দেওয়ার সময় বলা হল তাকে থাকতে হবে আত্মহত্যা রাজ্যে।
সে প্রতিবাদ করে বলেছিল আমি তো আত্মহত্যা করিনি, আত্মবলিদান করেছি। লাভ হয়নি। ওই শাসক ভূতেরা বলেছিল, ব্যাপার যাই হোক তোমার কেসটা আসলে আত্মহত্যাই। সমাজের কথাভেবে এখন যারা নিজেদের বলিদান দেয় তারা আসলে আত্মহত্যাই করে। আর তাই এখানে একগাদা ন্যাকা ন্যাকা আত্মহত্যা করা প্রেমিক/প্রেমিকা ভূতের মাঝখানে তাকে খারাপ লাগলেও বাস করতে হয়েছে। সে ওসব প্রেমটেমে বিশ্বাস করে না। তার কাছে আসল হল শোষণহীন দুনিয়া গড়ে তোলা, সাম্যবাদ ছড়িয়ে দেওয়া....
তবে কি মনে মনে চ্যাং এখন একটু হাসছে। সত্যি আড়াল করলে মানুষ যেমন ভিতর ভিতর হাসে, সেরকম হাসিটাই সে হাসছে। আসলে ভূত হওয়ার পর ভাল সে একজনকে বেসেছে। বলা ভালো ভালবেসে ফেলেছিল। ভূতেদের দেশে আস পর চ্যাং একটা জায়গায় কাজে ঢুকেছিল। বাহাদুরপুকুরে মাছ চুরির কাজ। খুব কম টাকার মাছজুরি (ভূতেরা মজুরিকে এ নামেই ডাকে) তবে এ কাজে সে একটা মজা পেয়েছিল। মজা না বলা ভাল আনন্দ, দারুণ একটা আনন্দ। সারারাত বেগার খাটনির পর যখন সে গাছে উঠে ঘুমোতে যত ,তখন দারুণ একটা সুখ পেত। কারণটা একজন।
চ্যাং যে পুকুরে মাছ চুরির কাজটা করত, সেই পুকুরেই মানুষকে ভয় পাওয়ানোর কাজটা করত জয় বাবা ভূতনাথ নামের একটা এজেন্সি। সেই এজেন্সিতেই কাজ করত শীরাকাটাপর্ণা নামের এক শাকচুন্যি। খোঁজ নিয়ে জেনেছিল মানুষ অবস্থায় ওই শাকচুন্যির নামটা ছিল অপর্ণা। প্রেমে আঘাত পেয়ে দুঃখে হাতের শিরাকেটে মরেছিল বলে এখানে ওর নাম হয়েছে শিরাকাটাপর্ণা। চ্যাঙ অবশ্য তাকে অপর্ণা নামেই ডাকত। দেখে মনেই হত না অপর্ণা আসলে শাকচুন্যি। কী দারুণ চোখ ওর। ভূতের চোখ মানেই বেঁচে থাকা মানুষদের কাছে ধারণাটা হল চোখ কোঠরে ঢোকা-ঢোকা,লাল-লাল,গোল-গোল।
অপর্ণার চোখটা মোটেও সেরকম নয়। অপর্ণা চোখ আসলে নীল, আর স্বচ্ছ, নিষ্পাপ একটা আয়নার মত। সেই অপর্ণার সঙ্গে দারুণ একটা সম্পর্ক হয়ে গেছিল চ্যাঙের। তবে সম্পর্কটা যখন জমে বরফ হতে যাবে তখনই বাধল বিপত্তিটা।
যে পুকুরে মাছচুরির কাজ চলছিল, সেখানে একটা ভূতকে অন্যায়ভাবে অপমান করে ন্যায মাজজুরি থেকে বঞ্চিত করে তাড়িয়ে দিল মালিকপক্ষ। চ্যাঙ প্রতিবাদ গর্জে উঠল। যতই হোক ভূত হলেও প্রতিবাদে সত্ত্বাটা তার মজ্জাগত। একাই পুকুরের পাশে পোস্টার হাতে আন্দোলন শুরু করল চ্যাঙ। মেট্রো, বিষাড়ু, অ্যাসিডদের মত জনা কুড়ি ভূত যোগ দিল তার আন্দোলনে। তারপর আস্তে আস্তে সংখ্যাটা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ল। আন্দোলনটা যখন দারুণ আকার নিচ্ছে,আন্দোলনের ঠেলায় কোম্পানি লকআউট হতে চলেছে, তখনই মোক্কম চালটা দিল মালিকপক্ষ।
বলা হল আন্দোলন থেকে সরে কাজে দিলে দ্বিগুন মাজজুরি দেওয়া হবে। ব্যস.. ভূতেদের নীতিবোধটা বড় ঠুনকো। লোভে পড়ে আন্দোলনকে মাথায় তুলে সব কাজে যোগ দিল। একমাত্র চ্যাঙ ছাড়া। যতই হোক সে সমাজের জন্য আত্মবলিদান করে ভূত হয়েছে, এখন মাজজুরির মোটা লোভের সামনে নীতিকে বিসর্জন দিতে পারবে না। তাই কাজ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল চ্যাঙকে। সঙ্গে শাস্তি হিসাবে বলা হল পুকুরের দশ কিলোমিটারের মধ্যে সে আর ঢুকতে পারবে না। তার মানে শিরাকাটাপর্ণার সঙ্গে যোগাযোগের আর কোনও উপায় থাকল না.. অপর্ণা তার কাছে মধুর অতীত হয়ে গেল। সব কিছু ছেড়েছুড়ে চ্যাং চলে গেল অনেক দূরে...
যাক ওসব অতীতের কথা আড়ালেই থাক। তার মত সমাজের জন্য আত্মবলিদান দেওয়া ভূতের কাছে প্রেমটেম মানায় না। সে বিদ্রোহী, সমাজসংস্করক। এবার চ্যাং চাঁদের দিকে তাকাল। না বেশ রাত হয়েছে। তাই খিদেটা বেশ চাগাড় দিয়েছে। এই যে বিয়েবাড়িতে সে এসেছে তার আসল কারণটাই পেটভরে খাওয়া। এই খাওয়া ব্যাপরটা ছাড়া কোনও বিয়েবাড়ি, ভূতাজিক অনুষ্ঠান তার ভাল লাগে না।
ভূতেরা এখনও বিয়েবাড়িতে আমন্ত্রণের জন্য কার্ড সিস্টেম চালু করতে পারেনি। তাই বিনা আমন্ত্রণেই যেকোনও বিয়েবাড়িতে যাওয়া যায়। সে আজ আজ একা একা ঘুরতে ঘুরতে অনেকটা পথ এসে সে এই বিয়েবাড়িটার সন্ধান পেয়েছে। চেনা মুখ বলতে সে মেট্রো, আর ঝোলাদের মত গুটি কয়েক ছাড়া আর কাউকে পায়নি। পাওয়ার দরকারও নেই চ্যাঙের। সে এই বিয়েবাড়িতে এসেছে শুধু খেতে, পেটভরে খেতে। খাওয়া হয়ে গেলেই সে পা মুছে পালাবে।
তবে কি ভূতেদের বিয়েবাড়ির এক সমস্যা যতক্ষণ না ভূতাচার শেষ হচ্ছে কেউ কিছু খেতে পারবে না। এবার পাত্রী এসে পরবে। ভূতেদের বিয়ের নিয়মটা হল, ব্রহ্মদৈত্য ভূত পাত্র-পাত্রীর দুটো পা দড়ি দিয়ে বেধে দেবে। তারপর পাত্রী সেই দড়িটা খুলে পাত্রের পিছনে লাথি মারবে। ব্যস তাহলে বিয়ের ভূতাজিক উপাচার সম্পূর্ণ।
এই তো পাত্রী এসে পড়েছে। পাত্রও তৈরি। তবে চ্যাং যেখান দাড়িয়ে সেখান থেকে দুজনের মুখটা দেখতে পাচ্ছে না চ্যাং। দেখার উত্সাহও নেই তার। সে শুধু খেতে এসেছে। বর বউ দেখে তার লাভ নেই। দেখে হবেই বা কী। সেই তো এক ছবি। বরের পাশে দাঁড়িয়ে বউ হাসছে।
তবে হঠাত্ বুকে বিস্ফোরণ ঘটে গেল চ্যাংয়ের। সে কি দেখছে এখন!! দু তিনটে ভূতকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে সে এগিয়ে গেল। আরে হ্যাঁ এই তো অপর্ণা। সেই চোখ, সেই তাকানো। চ্যাং এগিয়ে চলেছে, চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে... বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হবে বলে খুব জোরে বাজনা বাজানো হচ্ছে.. তার মধ্যেই শিরাকাটা পর্ণা বলে জোরে চেঁচিয়ে উঠল চ্যাং... বিয়ে বাড়ির তালটা কেটে গেল.. অপর্ণার হাতে গোলাপ কাঁটার মালাটা পরে গেল.. চ্যাং বলল, সব ছেড়ে চলে এসো অপর্ণা.. সবাই চমকে গেল.. এ যে অপরাধ পাত্রীকে বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা, তবু সবাই চুপ থাকল.. গলাটা আবার জোরে করে চ্যাং বলল, কী হল অপর্ণা এসো বলছি, আমি তোমায় ভাল রাখব...
এই কথাটা শুনে কেঁদে ফেলল অপর্ণা। সবাই ধরেই নিল পাত্রী ভয় পেয়ে গেছে.. তাই লাঠিসোটা নিয়ে তেড়ে গেল চ্যাংয়ের দিকে...
বাকিটা চ্যাং জানে না.. এখন সে শুয়ে পুকুরের ধারে। দূরে বিয়ে বাড়ির বাঁশ পেটানোর আনন্দের আওয়াজ পাচ্ছে.. মার খেয়ে গাটা খুব ব্যথা করছে চ্যাংয়ের.. তবে গায়ের ব্যথার থেকে মনের ব্যথাটাই আসল.. এতক্ষণে মালা পরানো হয়ে গেছে অপর্ণা। এখন অপর্ণা অন্য কারোর। কথাটা ভেবেই চ্যাং কেঁদে ফেলল। ভাবল আর বেঁচে থাকার কোনও অর্থ নেই। সমাজকে তখনই ভাল রাখা যায়, যখন নিজে ভাল থাকা যায়। নিজে ভাল থাকার আর কোনও কারণই নেই। তার ভাল থাকার তালার চাবিটা ছিল অপর্ণার কাছে। সেটাই যখন হাতছাড়া হয়ে গেল.. তখন আর বেঁচে থেকে লাভ কি! তাই কোনও রকমে পা ঘসে ঘসে এগিয়ে করাতটা তুলে নিল চ্যাং.. এবার সে আত্মহত্যা করবে.. হ্যাঁ ভূত হয়ে সে বুঝেছে মানুষ কেন ভালবাসার জন্য আত্মহত্যা করে। হ্যাঁ সেও সেটাই করবে... আত্মবলিদান নয় আত্মহত্যা।।
First Published: Saturday, February 16, 2013, 18:52